ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি: শিগগিরই মিলছে না টিকা পরীক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি

ওষুধ ও টিকা উৎপাদন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বাজারজাত এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। আর তা দেয়া হয় ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে (এনসিএল) পরীক্ষা বা যাচাইয়ের পর। ওষুধের জন্য পরীক্ষাগারটি বছর চারেক আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃতি পেয়েছে। টিকা পরীক্ষার স্বীকৃতি পেতেও কাজ করে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পরীক্ষাগার পরিদর্শন করে গেছে ডব্লিউএইচওর বিশেষজ্ঞ দল। তবে চূড়ান্ত স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এনসিএলকে আরো কয়েকটি নির্দেশকে উন্নতি করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ বলছে, টিকা পরীক্ষার সক্ষমতা এনসিএলের রয়েছে। নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাও করা হচ্ছে। ডব্লিউএইচওর বিশেষজ্ঞ দলটি গত মাসে পরীক্ষাগারটি পরিদর্শনে এসেছিল। তারা যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে সব বিষয়ই পর্যবেক্ষণ করেছে। কয়েকটি পরামর্শও দিয়েছে। সে অনুযায়ী এখন কাজ চলছে। ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতি পেলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিদেশী সংস্থা তখন বাংলাদেশের টিকা কিনবে। অথচ আগে টিকা পরীক্ষার জন্য ভারত ও থাইল্যান্ডের পরীক্ষাগারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. সালাহউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টিকা পরীক্ষার জন্য এনসিএলকে ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতি পেতে হলে আরো কিছু কাজ করতে হবে। এ কাজ চলমান। পরিপূর্ণভাবে শেষ হতে আরো ছয় মাস বা এক বছর লেগে যেতে পারে। অধিদপ্তরের ম্যাচিউরিটি লেভেল-৩ হলে আমরা টিকা পরীক্ষার জন্য স্বীকৃতি পাব। আমরা এখনো টিকা পরীক্ষা করি। তবে ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়ার পর ইউএন সংস্থাগুলোর কাছে টিকা বিক্রিও করতে পারব।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, বিদেশ থেকে আমদানি বা দেশে উৎপাদিত ওষুধ এবং টিকার মান নিশ্চিতের জন্য এনসিএলে পরীক্ষা বা যাচাই করা হয়। এর পরই তা অনুমোদন করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের এ গবেষণাগারটিকে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয় ডব্লিউএইচও। তবে তা শুধু ওষুধের ক্ষেত্রে। তখন থেকে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠানটি ডব্লিউএইচওর নির্বাচিত ওষুধমান পরীক্ষাগারের তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি পরীক্ষাগার এ তালিকায় স্থান পেয়েছে।

টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে দেশে প্রয়োগ করা হয় অন্তত ১৭টি টিকা। এর মধ্যে ১২টিই তৈরি হয় দেশীয় প্রতিষ্ঠানে, যেগুলো চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এনসিএলেই পরীক্ষা করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০২০ সালের এপ্রিলে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্প থেকে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে টিকা পরীক্ষাগারের সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু করা হয়। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশন অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসের (ইউএনওপিএস) মাধ্যমে কেনা হয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে নিয়োগ হয় প্রয়োজনীয় লোকবল। সেই সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কেমিক্যাল রি-এজেন্ট ও যন্ত্রাংশ মেরামত করা হয়।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পশুর দেহে প্রয়োগের জন্য টিকার সব ব্যাচের পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে টিকার নিবন্ধন যাচাই করা হয়। তবে মানবদেহে প্রয়োগের একই টিকার সব ব্যাচের জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন। আর টিকা পরীক্ষার পূর্বযোগ্যতা অর্জনে ডব্লিউএইচও ম্যাচিউরিটি লেভেল-৩-এ উন্নীতকরণ জরুরি। এ লেভেল অর্জন করতে পারলে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর তৈরি ওষুধের মতো টিকাগুলোও বৈশ্বিক বাজারে অবস্থান নিতে পারবে।

ডব্লিউএইচওর ম্যাচিউরিটি লেভেল-৩-এর নয় ধরনের কার্যক্রম (নাইন ফাংশন) রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টিকা নিবন্ধন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বাজার পর্যালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ, ফার্মাকোভিজিল্যান্স, মান নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা ইত্যাদি। এছাড়া আইনি ক্ষমতা দেয়া আছে কিনা, তাদের কারিগরি সহায়তা আছে কিনা, সম্পদ, দক্ষ জনবল আছে কিনা এসব বিষয়ও মূল্যায়ন করবে ডব্লিউএইচও। তারা দেখবে, আন্তর্জাতিকমানের বা ডব্লিউএইচওর মান অনুযায়ী হচ্ছে কিনা ও কাজগুলো কতটুকু স্বচ্ছ।

টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় টিকা কতটুকু নিরাপদ ও কার্যকর সেই বিষয়টি। কোনো টিকা পশু-পাখির শরীরে প্রয়োগের জন্য আবার কোনো টিকা মানবদেহে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মানুষের জন্য টিকা হলে তা ডব্লিউএইচওর মানদণ্ডে আর পশুর জন্য হলে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ওআইই) মানদণ্ডে তৈরি করা হয়।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অণুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে টিকা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। তবে মূল বিষয়টি হলো এর সেফটি। এ সেফটি বা নিরাপত্তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা কঠিন। মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বিষয়। পরীক্ষাগারের বায়োসেফটি নিশ্চিত করা সহজ নয়। টিকা তৈরির সক্ষমতা থাকলেও পরের স্তরের সক্ষমতা আমাদের নেই। এনসিএল ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতি পেলে তা বড় একটি অর্জন হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাতে টিকা উৎপাদন ও বাজারজাতে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার পরীক্ষা নির্ভর করে তার ধরনের ওপর। প্রতিটি জীবাণু প্রতিরোধী টিকার জন্য আলাদা পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। জীবাণুর স্বভাবের ওপর এগুলো নির্ভর করে। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের টিকার পরীক্ষা ভিন্ন। যেমন ব্যাকটেরিয়ার কোনো টিকার পরীক্ষার জন্য যতটা নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন, ভাইরাসের টিকার জন্য তার চেয়েও বেশি বায়োসেফটি লেভেলের পরীক্ষাগার প্রয়োজন। বাতাসে যেসব জীবাণু ছড়ায়, সেসব টিকা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার উচ্চ ক্ষমতার হতে হবে। তবে বায়োসেফটি লেভেল-৩ অর্জন হলে বাংলাদেশ টিকা পরীক্ষায় অনেক এগিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার শ্রেণীবিভাগকে বায়োসেফটি লেভেল বলা হয়। বায়োসেফটি লেভেলের চারটি শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। প্রতিটি স্তরের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে যা পরীক্ষাগার অনুশীলন, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও সুবিধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি স্তরের অগ্রগতির সঙ্গে পূর্ববর্তী স্তর থেকে অতিরিক্ত জৈব নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়। প্রথম স্তরে স্বাভাবিক পরীক্ষাগার। সেখানের বাতাস পরীক্ষাগারের বাইরে গেলে তার চারপাশের পরিবেশের ক্ষতি হবে না। সব যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে কাজ করবে। দ্বিতীয় স্তরের পরীক্ষাগার হচ্ছে যেখানের বাতাস মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ফলে হঠাৎ কোনো সমস্যা হলে ল্যাবে কাজ করা মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে তা সুনির্দিষ্ট করা। বাইরের ক্ষতি এড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয় স্তর হচ্ছে যারা কাজ করবেন তারা কীভাবে প্রবেশ করবেন, বের হবেন তা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে সেখানের কোনো বাতাস বাইরে বের হবে না তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর চূড়ান্ত বা চতুর্থ স্তর হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়। এখানে যারা কাজ করেন তারা বেশিক্ষণ কাজ করতে পারেন না। তাদের বায়োসেফটিক পোশাক পরে কাজ করতে হয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডব্লিউএইচও এপ্রিলে আমাদের পরীক্ষাগার পরিদর্শন করে গেছে। তারা কিছু অবজারভেশন দিয়ে গেছে। তিন মাস পর আবার আসবে। ম্যাচিউরিটি লেভেল-৩ অর্জন করতে হলে আরো অনেক কাজ করতে হবে। নাইন ফাংশনের প্রত্যেকটা বিষয় তারা দেখবে। তারা ফাইলিং পর্যন্ত দেখে। তারা প্রত্যেকটা বিষয়ে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করে। এসব আমাদের দেশে এতদিন প্র্যাকটিস ছিল না। এখন প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে। এজন্য কোনো না কোনো জায়গায় তারা ত্রুটি পেয়ে যায়। টিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন টিকা পরীক্ষা করে দেশের মধ্যে চালাচ্ছি। বিশ্ববাজারে আমাদের টিকা যেতে হলে ওদের স্বীকৃতি লাগবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: