টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) অন্যান্য সূচকে উন্নতি হলেও এখনো পুষ্টি খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও জনসাধারণের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতি অর্থবছরই এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখে সরকার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন নানা প্রকল্পের আওতায় এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তবে এ বার্ষিক বরাদ্দের ৯৮ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে পুষ্টিসংক্রান্ত সভা, সেমিনার, প্রচার-প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের মতো কার্যক্রমে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই জনসাধারণের অপুষ্টি দূরীকরণের বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিছুটা উন্নতি হলেও দেশের নবজাতক, শিশু ও নারীসহ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনো স্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এ অপুষ্টি দূরীকরণে সরকারের ২২টি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তবে মোটা দাগে ১৩টি মন্ত্রণালয় এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য চিকিৎসা, সরাসরি খাদ্য বিতরণ ও ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, এমআইএনটি পাউডার, মিনারেল খাওয়ানোর মতো কর্মসূচিগুলোকে বিবেচনা করা হয় প্রত্যক্ষ কার্যক্রম হিসেবে। পরোক্ষ কার্যক্রম হিসেবে ধরা হয় অপুষ্টি দূরীকরণসংক্রান্ত সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কর্মসূচিকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, অপুষ্টি দূরীকরণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমেরই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পরোক্ষ কার্যক্রম এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পরিচালিত বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রকাশনায় দেখা যাচ্ছে, দেশে অপুষ্টি দূরীকরণে পরোক্ষ কার্যক্রমই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ বাবদ সরকারের মোট ব্যয়ের মাত্র ২ শতাংশ খরচ হয়েছে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে। বাকি অর্থের পুরোটাই গিয়েছে সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণার মতো পরোক্ষ কর্মসূচিতে। এর মধ্যে শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই পুষ্টিসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে মোট ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল সরকার, যা দেশের মোট জিডিপির ১ শতাংশ। ওই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এ ব্যয়ের অংশ প্রায় ৯ শতাংশ।
সরকারি ব্যয়ে পরোক্ষ কার্যক্রম গুরুত্ব পেলেও অপুষ্টি দূর করতে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে মনোযোগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে এমন উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল মনে করছেন, পরোক্ষ কার্যক্রম তুলনামূলক বেশি দৃষ্টিগোচর হয় বলেই সেদিকে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগও থাকে বেশি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে পরিকল্পনা হয় এক রকম আর বাস্তবায়ন হয় অন্য রকম। প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত পুষ্টির ছোঁয়া লাগছে না। সরকার বড় পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর সুফলভোগী কম। পুষ্টিতে এখনো ছোট ছোট অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সমন্বয়ের অভাব। কেউ প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সচেতনতার কাজ করলে অন্যরা সরাসরি পুষ্টি কার্যক্রম করতে পারে। কিন্তু তা না করে সবাই একই কাজ করছে। সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টি নিশ্চিতে খাবার, ভিটামিন, ক্যালসিয়া, আয়রন ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। অন্যথায় কাগজে কলমে পুষ্টির উন্নতি হলেও তাতে লাভের লাভ কিছুই হবে না।
দেশে এখনো অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক বেশি। জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বতায় ভুগছে ৩১ শতাংশ। ৮ শতাংশ ভুগছে তীব্র অপুষ্টি বা কৃশতায়। বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ শিশুর। এছাড়া শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে সাব-ক্লিনিক্যাল আয়োডিনের স্বল্পতাও রয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে শিশুদের ৪০ শতাংশই এ সমস্যায় ভুগছে। আর নারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যায়। বর্তমানে রক্তস্বল্পতা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। সেখানেও পুষ্টির প্রত্যক্ষ কার্যক্রম কম রয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, পুষ্টিতে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ৯০ শতাংশ বাড়ানো হলেও তাতে শুধু খর্বতা ও গুরুতর তীব্র অপুষ্টির প্রাদুর্ভাবের আংশিক কমানো সম্ভব হবে। এর মধ্য দিয়েই পুষ্টির পরোক্ষ কার্যক্রমের গুরুত্ব উঠে আসে। দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরোক্ষ কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ তাদের অপুষ্টির ঝুঁকি বেশি।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টিপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পুষ্টির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০০ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি) রয়েছে ৩১টি। এ ৩১ পরিকল্পনার মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে ১৯টি। প্রতি বছরই পুষ্টি কার্যক্রমের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অংকের বরাদ্দ রাখা হয়। সরকারের ১৭টি বহুমুখী পুষ্টি পরিকল্পনার সমন্বয়ে জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। প্রায় এক যুগ ধরে চলমান সরকারের বড় এ কর্মসূচি ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, পুষ্টির পরোক্ষ কার্যক্রমে সারা বছরই বিভিন্ন ওপিতে প্রশিক্ষণ, সচেতনতামূলক সভা করা হয়। বর্তমানে সারা দেশে প্রান্তিক পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের পরামর্শ দিচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে পুষ্টিগুণ মেশানোর কাজ করে। যেমন লবণে আয়োডিন ও ভোজ্যতেলে পুষ্টিগুণ মেশানো হয়। এসব কাজ পরোক্ষ কার্যক্রমের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মূলত প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম করে।
জাতীয় পুষ্টি পরিষদের প্রকাশনার তথ্য অনুযায়ী, সার্বিকভাবে ২২টি মন্ত্রণালয় পুষ্টিসংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। তবে পুষ্টিসংক্রান্ত প্রকল্প ও অপারেশনাল লাইনগুলো ১৩টি মন্ত্রণালয়ে বিস্তৃত। পুষ্টি খাতে সর্বাধিক ৮০ শতাংশ ব্যয় করে চারটি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় ৩৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২৩, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৩ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭ শতাংশ ব্যয় করেছে।
পুষ্টি খাতে উন্নতির জন্য সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, শুধু অর্থ ব্যয় করলেই পুষ্টির উন্নতি হবে না। প্রত্যক্ষ কার্যক্রম না বাড়ালে পুষ্টি নিশ্চিত করা যাবে না। তবে অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর পুষ্টির জন্য খাবার সরবরাহ ও ভিটামিন বা ক্যালসিয়াম খাওয়ানোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সুযোগ তুলনামূলক কম। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যক্রমের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয় করতে হবে। কিছু মানুষ আছে যারা অসচেতন, তাদের সচেতন করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আবার কিছু মানুষ আছে, তাদের সচেতন করার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টির জন্য সরাসরি খাবারও সরবরাহ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম আকতারুজ্জামান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের মধ্যে কোন গোষ্ঠী অপুষ্টিতে রয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে জানা যাচ্ছে। সেখানে প্রত্যক্ষ কার্যক্রম এখনো বাড়ানো হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পুষ্টির বিষয়ে কাজ করছে। পরিধি বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় প্রত্যক্ষ কার্যক্রম বাড়েনি। দেশের এখনো ১১ শতাংশ মানুষ প্রায় অর্ধাহারে থাকছে। ৩০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। বাল্যবিবাহ ও অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ফলে সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। সরকারি পুষ্টিতে বিনিয়োগ বা ব্যয়ের মাধ্যমে তাদের অপুষ্টি দূর করা যেত। আমার মনে হয় বুঝে না বুঝে কাজ করার কারণে সরকারের সংস্থা বা মন্ত্রণালয়গুলো পুষ্টির প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের বিষয়ে উদ্যোগী হচ্ছে না।
বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পুষ্টির জন্য সারা দেশে বছরজুড়ে ১৫ ধরনের সেবা দিয়ে আসছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালের মাধ্যমে এ সেবা দেয়। ক্যাম্পেইনের মাধ্যমেও প্রত্যক্ষ সেবা দিচ্ছে সরকারের সংস্থা দুটি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফও মনে করছেন, পুষ্টির বিষয়ে প্রত্যক্ষ কার্যক্রম কম। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। প্রত্যক্ষ কার্যক্রম বাড়ানোর বিষয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে অনেক অপুষ্টির বিষয় রয়েছে। এগুলো গুরুত্ব দিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে।
একই মত পোষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান বলেন, কিছুটা ঘটতি রয়েছে। প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে সেবা বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ বর্তমানে পুষ্টি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে সমন্বয়ে কাজ করছে। পরিষদের মহাপরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু একক কারণে অপুষ্টি দূর হয় না। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। বিষয়টি ব্যক্তিগত হাইজিন, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। শুধু প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের মাধ্যমে পুষ্টি নিশ্চিত করা যায় না। আর কেবল সভা-সেমিনার বা প্রশিক্ষণ নিয়েই যে পরোক্ষ কার্যক্রম শেষ হয়েছে, তা নয়।
তবে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে খরচ বাড়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রামে মায়েদের বিভিন্ন ভাতাও দেয়া হয়, কিন্তু তারা তা পুষ্টিতে খরচ করে না। তাদের এ বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করা হয়। বাংলাদেশে পুষ্টির বিষয়ে অনেক কার্যক্রম রয়েছে। এগুলো সমন্বয়ের কাজ চলছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে। আমরা সব একত্র করার চেষ্টা করছি। এর পরই বলতে পারব, কারা আসলে কী করছে।