স্বাস্থ্যসেবা খাতে চিকিৎসকদের পর সবচেয়ে বেশি অবদান যারা রাখেন তারা নার্স। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল বলছে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন করে নার্স থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এ সংখ্যা দশমিক ৩০ জন। নার্সের এ স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা। দেশে নার্স সংকটের নানা কারণ উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে ৮৬ শতাংশ নার্স নিজ কর্মস্থলে তুলনামূলক খারাপ পরিবেশে কাজ করেন।
‘ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অ্যান্ড অকুপেশনাল স্ট্রেস অ্যামং নার্সেস ইন বাংলাদেশ: আ ক্রস সেকশনাল পাইলট স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় বাংলাদেশের নার্সদের বিভিন্ন সংকট ও সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, সামাজিক বৈরিতা, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, রোগীর স্বজনদের অসদাচরণ, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা, পদোন্নতির ঘাটতির কারণে নার্সদের ওপর পেশাগত চাপ থাকে। মূলত এগুলোই নার্স স্বল্পতার কারণ।
রাজধানী ঢাকার একটি বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালের ১৮৬ জন নার্সের ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। দুই মাস তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ক্রস সেকশনাল জরিপ ও নিজস্ব প্রশ্নপত্রের গবেষণা পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়। গুণগত ও পরিমাণগত এ গবেষণায় পেশাগত চাপের বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, কোলাহলমুখরতা, আলোকস্বল্পতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও বাতাস চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত স্থানের কারণে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো নয়। এ তথ্য জানিয়েছেন ১৩৩ জন নার্স। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ নার্স কর্মজীবনে পদোন্নতি পাননি। পদোন্নতি না পাওয়া এসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ১০ থেকে ২০ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে পেশাগত চাপ তৈরি হয়।
গবেষক দলের সদস্য ডা. ওয়াতিন আলম বলেন, দেশের নার্সরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক চাপে পড়েন। গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখেছেন, সামাজিকভাবে এখনো নার্স পেশার প্রতি তেমন সমর্থন তৈরি হয়নি। রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজন ও প্রতিষ্ঠানের চাপের কারণে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি হয়। এতে মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়েন বলে কাজের যথাযথ মানের ক্ষতি হয়।
এ গবেষক জানান, বাংলাদেশে নার্সদের পেশাগত সমস্যা নিয়ে এর আগে তেমন গবেষণা হয়নি। পাইলট স্টাডি হিসেবে এ গবেষণা করলেও শিগগিরই আরো বড় পরিসরে কাজটি করবেন তারা। তখন আরো ব্যাপক ফলাফল পাওয়া যাবে।
দেশে নার্সদের ওপর পেশাগত চাপের বিষয়টি স্পষ্ট হয় বিভিন্ন হাসপাতালে গেলে। যেমন রাজধানীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালে নার্সের পদ রয়েছে ১৪৫টি। এর বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৭৮ জন। আবার দ্বীপ জেলা ভোলার সদর হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন তিনশর বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। সিভিল সার্জন জানান, এ-সংখ্যক রোগীকে যথাযথ সেবা দিতে অন্তত ১১০ জন নার্স প্রয়োজন। সেখানে নার্স রয়েছেন মাত্র ৬০ জন। স্বাভাবিকভাবেই এ নার্সদের ওপর অনেক বেশি কাজের চাপ পড়ে যায়।
বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বণিক বার্তাকে জানান, দেশে ৭১ হাজার ৩৬৯ জন নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন প্রায় ৩৭ হাজার। দেশে তিন লাখের বেশি নার্সের প্রয়োজন থাকলেও তা নেই। ফলে কমসংখ্যক নার্সদেরই অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স পদে কর্মরত রোকসানা মল্লিক (ছদ্মনাম)। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এ পেশায় যুক্ত থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি পাননি তিনি। কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার পাশাপাশি রোগীর স্বজন ও প্রাতিষ্ঠানিক ভর্ত্সনা তাকে পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। তাছাড়া নার্সরা সামাজিক অবমূল্যায়িত হওয়ায় এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন।
নার্সদের অধিকার রক্ষায় গঠিত সংগঠন সোসাইটি ফর নার্স সেফটি অ্যান্ড রাইটস বলছে, শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশে অর্ধেক নার্সই মানসিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। করোনাকালে এ সংকট আরো প্রকট হয়েছে। তারা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, চাপ নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। সংগঠনটির মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্স সাব্বির মাহমুদ তিহান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই সুদৃষ্টির বাইরে থেকে যাচ্ছি। যথাযথ প্রাপ্তি মিলছে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও উপযুক্ত নীতিমালা নেই। ফলে ১০ থেকে ২০ বছর কাজ করার পরও পদোন্নতি মিলছে না। এখন কিছুটা পরিবর্তন হলেও তা বেশ ধীরগতিতে চলছে। এর মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মানসিক চাপে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ৫০ শতাংশই নার্স। পেশাগত চাপ ও সামাজিক মূল্যায়ন না থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী নার্সের সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এ সংকট বেশি। এতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৯০ লাখ নার্স প্রয়োজন হবে। প্রতিটি দেশের ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে এ সংখ্যা তিনজন।
প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স তৈরিতে সরকারের ভূমিকা আরো বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশান আরা বেগম। তিনি বলেন, ষাটের দশকে নার্স পেশায় যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। তবে এ সমস্যা এখন কম। বরং এখন বেশ প্রতিযোগিতা রয়েছে। অবশ্য সংকট পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। মানসিক চাপ, অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রশাসনিক ও রোগীর চাপ নার্স স্বল্পতার অন্যতম কারণ হতে পারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই সেবা ব্যাহত হবে। সেবায় নিয়োজিতদের মানসিক চাপ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের মান কমে যায় বলেও মন্তব্য করেন এ চিকিৎসক।
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে সবসময়ই নার্সদের বিষয়টি আলোচনার বাইরে থেকে যায় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিবেশ ও পেশাগত স্বাস্থ্য বিভাগের সভাপতি ডা. শফিউর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে নার্সদের সংখ্যা কম। ঢাকার বাইরে নার্সরা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন। তারা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় স্থানীয় মাস্তান ও প্রাতিষ্ঠানিক রোষানলেও পড়েন। একই সঙ্গে সামাজিক কটূক্তি এখনো বহাল রয়েছে। শিফটিং পরিবর্তনের সময় তারা যাতায়াতে নিরাপত্তা পান না। চলমান জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ করে গেলেও সৌজন্য ব্যবহারটুকুও তাদের দেয়া হচ্ছে না। এর আগের বছর ডেঙ্গু, বার্ড ফ্লুসহ বিভিন্ন জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে যথাযথ ব্যবহার তারা পাননি। যার কারণে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এটি উত্তরণে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।