বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য তিনটি করে ছয়টি হোস্টেল রয়েছে। সব হোস্টেলের অবস্থা জরাজীর্ণ। বৃষ্টিতে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, প্রায়ই খসে পড়ে ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা। একই অবস্থা দেশের প্রায় সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের। দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সেগুলো। বিকল্প আবাসনসুবিধা না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই তাতে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ১৯টি হোস্টেল নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রকল্প শুরুর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ হয়নি ১ শতাংশও।
প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় গত বছরের ১ জুলাই। ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পে ভৌত অবকাঠামোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া আসবাবের জন্য ৩৪ কোটি ৮৫ লাখ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির জন্য ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং বাকি অর্থ ব্যয় হবে অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে।
চার বছর মেয়াদের এই প্রকল্প ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। সে হিসাবে সময় বাকি আছে আড়াই বছর। কিন্তু কাজ বাকি শতভাগ।
প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। আর চলতি অর্থবছরে ছাড় দেওয়া হয়েছে ১৪৯ কোটি টাকা। যদিও এ পর্যন্ত ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নির্মাণকাজ শুরুর প্রত্যাশা নিয়ে ওই টাকা ছাড় চাওয়া হয়েছিল। তবে দরপত্র আহ্বান করেও স্থগিত করার কার্যক্রম থেমে যায়।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প শুরুর এক বছর পর চলতি বছরের ৯ জুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো নিয়োগ হয়নি অন্যান্য জনবল। সারা দেশের প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য যানবাহন নেই। প্রকল্প অফিসের জন্য রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরাতন ভবনের তিনটি কক্ষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আগামী বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যালয় ওই ভবনে স্থানান্তরিত হলে তবেই পাওয়া যেতে পারে ওই কক্ষগুলো। প্রকল্পের কাজ বলতে তিনটি কলেজের হোস্টেল নির্মাণের স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত দুই দফায় ৮টি হোস্টেলের জন্য দরপত্র আহ্বান করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দরপত্র স্থগিত করা হয়।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (অলটারনেটিভ মেডিসিন) ডা. মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমি চলতি বছরের জুনে নিয়োগ পেয়েছি। খুব শিগগিরই কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। নির্মাণকাজ শুরু হলে তা বাস্তবায়ন করতে ২৪ মাস সময় লাগবে বলে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে। তারপর আসবাব ও বাকি কেনাকাটা করা হবে। আশা করি প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।’
এদিকে প্রকল্পের এমন শম্বুকগতিতে দুশ্চিন্তায় আছে আবাসনসংকটে থাকা মেডিকেল কলেজগুলো। কারণ অনেক কলেজে বিদ্যমান জরাজীর্ণ হোস্টেল ভেঙে সে স্থানে নতুন হোস্টেল নির্মাণ করতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ভেঙে ফেলতে হচ্ছে স্যার সলিমুল্লাহ, শের-ই-বাংলা এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের বিদ্যমান ছাত্র হোস্টেল ভবন। ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. মাজহারুল শাহীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভবন নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করবে বলে আমাদের জানিয়েছে। ছাত্রদের হোস্টেলটি ভেঙে ফেলে সেখানেই তাদের জন্য ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান ৬ তলা ভবনের হোস্টেলটিতে দুই শতাধিক ছাত্র থাকছে। এখন তাদের কোথায় শিফট করব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। ভবন নির্মাণ শুরু হলে কয়েক বছর লেগে যাবে। এতে দেখা যাবে, একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে ডিগ্রি অর্জন করা পর্যন্ত ছাত্রাবাসের আবাসিক সুবিধা নাও পেতে পারে। কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে তা জানি না।’
ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় হোস্টেল নির্মাণ করা হবে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেটের এম এ জি ওসমানী, রাজশাহী, রংপুর, বরিশালের শের-ই-বাংলা, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও খুলনা মেডিকেল কলেজে। প্রতিটি কলেজের জন্য ৮ থেকে ১৫ তলার একটি ছাত্র হোস্টেল ও একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মিত হবে। তবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে নির্মিত হবে শুধু ছাত্রী হোস্টেল। বর্তমানে এসব কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৪৬ জন। হোস্টেল ভবনগুলো নির্মাণ করা গেলে তাতে ৪ হাজার ৩৯৬ জন ছাত্রী এবং ৪ হাজার ৫১২ জন ছাত্রীর আবাসনব্যবস্থা হবে। পুরাতন হোস্টেলগুলোতে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনের সংকুলান হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। উপদেষ্টা মহোদয়ের সিদ্ধান্ত ছিল যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো স্থাপনার কাজে হাত দেওয়া হবে না। তবে সম্প্রতি তিনি ছাড়পত্র দিয়েছেন। আবার দরপত্র আহ্বান করা হবে। প্রকল্পে যানবাহন নেই। যানবাহন ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটু বিধিনিষেধ আছে। প্রকল্প হলেও আলাদাভাবে অনুমতি নিতে হয়। তারপরও আমরা যেগুলো অত্যাবশ্যক মনে করি, সেগুলোর ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাই। এর মধ্যে দু-একটা অনুমোদন দিয়েছে। আর অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি কেনার পরিবর্তে ভাড়া নেওয়ার জন্য বলা হয়। প্রকল্পের কাজ যেন যথাসময়ে শেষ করা যায়, তার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’