বিষধর সাপের দংশনে আহত রোগীকে বাঁচাতে সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সংরক্ষণ করেছে সরকার। তবে সংরক্ষণ করা অ্যান্টিভেনম দু-তিন হাজার রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা যাবে। যদিও শুধু বিষধর সাপের দংশনে বছরে প্রায় এক লাখ মানুষ আহত হন, আর মারা যান সাড়ে সাত হাজার রোগী। অন্যদিকে বছরের ব্যবধানে অ্যান্টিভেনমের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে প্রতি লাখে ২৪৪ জন সাপের দংশনে আহত হন। এর মধ্যে মারা যান চার থেকে পাঁচ জন। সেই হিসাবে বছরে চার লাখের বেশি মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ বিষধর, যা সংখ্যায় সাড়ে ৯৬ হাজার। আর মারা যাচ্ছেন ৭ হাজার ৫১১ জন। তবে বিষধর সাপের দংশনের ঘটনার ৯৫ শতাংশ গ্রামের।
দেশে বিষধর সাপের দংশনের ক্ষেত্রে যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হচ্ছে তা মূলত একটি কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি করা হয় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষেধকটি পার্শ্ববর্তী ভারতের তামিলনাড়ুতে উৎপাদিত। দেশটি থেকে অ্যান্টিভেনমের তরল বাল্ক দেশে আমদানি করে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটি তরল বাল্ক আমদানির পর তা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বোতলজাতের পর স্নেক ভেনম অ্যান্টিসিরাম বিপি নামে বাজারজাত করে। প্রতিটি ভায়ালের (বোতল) বর্তমান দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। গত বছরও দাম ছিল ১ হাজার টাকা।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম আমদানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি বছর সরকারের চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা হয়। এর সঙ্গে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাজারজাতে বাড়তি কিছু আনা হয়। প্রতি ১০ ভায়ালে প্রস্তুত করা হয় এক ডোজ।
প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ বিপণন ব্যবস্থাপক (ভ্যাকসিন) ফারহানা লাইজু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনার খরচ বাড়ায় দাম আগের বছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। আমরা তরল এনে তা পাউডারে রূপান্তর করে বোতলজাত করি। এতে অতিরিক্ত লাভের সুযোগ নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ইনসেপ্টার কাছ থেকে ২০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম কিনেছে সরকার। বছরের ব্যবধানে ৪০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে অ্যান্টিভেনম কিনতে হয়েছে। সাধারণত প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ ভায়াল, জেলা হাসপাতালে ৫০ ভায়াল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল করে দেয়া হয়। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। বিষধর সাপে কাটা প্রতি রোগীকে এক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। গত অর্থবছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মাধ্যমে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম সহায়তা পেয়েছিল সরকার। এ বছরও ডব্লিউএইচওর কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০ থেকে ৩০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে সরকার। ডোজ হিসাব করলে সংখ্যা দাঁড়ায় দুই থেকে তিন হাজার। অর্থাৎ দুই থেকে তিন হাজার রোগীকে বাঁচানো যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চাহিদা অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম হাসপাতালে সরবরাহের চেষ্টা করি। দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপার রয়েছে। আমরা সব জেলাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের দেশে যে অ্যান্টিভেনম রয়েছে, তা সব সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসেবে প্রস্তুতকৃত একটি মিশ্রণ। বিভিন্ন দেশের সাপের প্রকৃতি ও বিষের ভিন্নতা থাকায় চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি অপরিহার্য।’
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইব্রেরি অব মেডিসিন এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী এলসিভিয়ার বলছে, সাপের অ্যান্টিভেনম দুই ধরনের—মনোভ্যালেন্ট ও পলিভ্যালেন্ট। একক প্রজাতি সাপ থেকে প্রাপ্ত অ্যান্টিভেনম হচ্ছে মনোভ্যালেন্ট। অর্থাৎ রোগীকে যে সাপে কেটেছে তাকে ওই সাপের অ্যান্টিভেনমই প্রয়োগ করা হয়। আর দুই বা ততোধিক প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বানানো হয় পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশে প্রয়োগ করা পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম সব ধরনের সাপের বিষের বিপরীতে কার্যকর নয়। কিং কোবরা (গোখরা), ক্রেইট (শঙ্খিনী) ও রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া)—এ তিন প্রজাতির তিনটি সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসেবে দেশে প্রচলিত অ্যান্টিভেনম কাজ করে। সামুদ্রিক সাপ ও পিট ভাইপার ও দুর্লভ ক্রেইটসহ অন্যান্য বিষধর সাপের বিষের ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিভেনম কার্যকর নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানভিত্তিক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান প্রকুইস্টে প্রকাশিত বাংলাদেশী এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৮২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। যার মধ্যে ২৮ প্রজাতি বিষধর।
১৯৯৩ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের প্রয়োগ শুরু করেন অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পর কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে কয়েকটি ওষুধ রোগীর শরীরে প্রয়োগ করতে হয়। যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তা অন্য ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে। ফলে ওইসব ওষুধ হাসপাতালে থাকার কথা। উপসর্গ অনুযায়ী অ্যান্টিভেনমের ডোজ ও অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। বিষধর সাপে কাটা রোগীকে বাঁচাতে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ অন্যতম চিকিৎসা, তবে একমাত্র চিকিৎসা নয়।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিলম্বে হাসপাতালে আসা। রোগীদের বেশির ভাগ প্রথমে ওঝার কাছে যান। যথাসময়ে এসে হাসপাতালে চিকিৎসার পর মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, সাপের দংশনের রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরির কথা বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ প্রকল্প চালু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরীক্ষামূলক অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য অর্ধসহস্র দেশীয় সাপ সংগ্রহ করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটি এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। তবে এখনো অ্যান্টিভেনম উৎপাদনে যেতে পারেনি ওই প্রকল্প।