প্রসবপূর্ব সেবা: চতুর্থ পর্যায়ে এসে বাদ পড়ছেন দুই তৃতীয়াংশ প্রসূতি

গর্ভকালীন প্রসূতি ও অনাগত সন্তানের সঠিক পরিচর্যার জন্য দেয়া হয় প্রসবপূর্ব সেবা বা এন্টিনেটাল কেয়ার (এএনসি)। পরিপূর্ণভাবে এ সেবা নিতে পারছেন না দেশের প্রসূতিদের বড় একটি অংশ। অন্তত দুই-তৃতীয়াংশের বেশি প্রসূতি প্রসবপূর্ব সেবার চতুর্থ পর্যায়ে এসে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন। এতে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হারে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলছে, প্রসবপূর্ব সেবা প্রসূতিদের প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে, গর্ভাবস্থা ও প্রসবের সময়ের করণীয় বুঝতে সহায়তা করে। প্রতিরোধমূলক এ স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে নারীর গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর আচরণ সম্পর্কে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী সচেতনতা সৃষ্টি করেন।

গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রসূতিকে কমপক্ষে চারবার এ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা বাদে সারা দেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। প্রসূতিবিদ্যায় অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রসূতিদের বাড়িতে যান।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০ সালে এএনসি সেবার প্রথম পর্যায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছিলেন ১ লাখ ৪৯ হাজার ২২৭ প্রসূতি। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৯ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে ৫১ হাজার ও চতুর্থ পর্যায়ে সেবা নিয়েছেন ৫০ হাজার প্রসূতি। একইভাবে ২০২১ সালে প্রথম পর্যায়ে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬১৬, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৭ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে ৪৭ হাজার ও সর্বশেষ চতুর্থ পর্যায়ের প্রায় ৪৯ হাজার প্রসূতি সেবা নিয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে সেবা নেয়া প্রসূতির মধ্যে ৬৮ শতাংশই চতুর্থ পর্যায়ে ঝরে পড়েছেন।

প্রসবপূর্ব সেবায় ঘাটতি হলে প্রসূতি ও গর্ভের সন্তান ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন গাইনি, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রসূতিকে অবশ্যই এন্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসতে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত গর্ভের সন্তানের বয়স ১২, ২৮, ৩২ ও ৩৬ সপ্তাহ থাকাকালে চিকিৎসক বা প্রসূতিবিদ্যায় অভিজ্ঞ ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ প্রসূতির জন্য জরুরি।

গাইনোকলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক আগে থেকেই আমরা দেখছি যে, চারটি প্রসবপূর্বের সেবায় পৌঁছতে পারছি না। শুরুতে প্রসবপূর্ব সেবায় প্রসূতিদের আনতে পারলেও পরে তাদের আনা যাচ্ছে না। এএনসি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই আমরা নির্ণয় করতে পারি ওই প্রসূতি কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভধারণের আগেই অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, রক্তস্বল্পতা, স্থূলতা, থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে গর্ভকালীন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এগুলো নির্ণয় করে আগে থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে নেয়া গেলে গর্ভকালীন সময়ে ঝুঁকি কমে যায়। গর্ভকালীন সময়ে প্রসবপূর্ব সেবা অনেক ঝুঁকি এড়িয়ে নেয়া যায়।

তার মতে, প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের উৎসাহ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রসূতি পরিবারের সমর্থন পান না অথবা তাদের সেবার জন্য নিয়ে আসা হয় না। তাদের মায়েরা এমন সেবা ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়েছেন—এ ধরনের একটি ভ্রান্ত ধারণা সমাজে রয়েছে। প্রসবপূর্ব সেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। প্রথমবার এলে যেন পরে তা অব্যাহত থাকে এমন বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য পরামর্শক সংস্থা জেএসআইতে কর্মরত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নানের মতে, প্রসবপূর্ব সেবা আগের থেকে বেড়েছে। তবে সরকারি সুবিধায় প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার চেয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ সেবা নেয়ার হার বেড়েছে। প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ প্রসূতি একবার হলেও প্রসবপূর্ব সেবা নিচ্ছেন। এটা অগ্রগতি। তবে এএনসি গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায় মানসম্মত সেবা পাচ্ছেন ৬০-৬৫ শতাংশ প্রসূতি। চতুর্থ পর্যায়ের এন্টিনেটাল কেয়ার নিচ্ছেন মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ প্রসূতি। গর্ভকালীন সময়ে জটিলতায় না পড়লে প্রসূতিরা এএনসি নিতে আসেন না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মো. মাহমুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সচেতনতার অভাবে প্রসবপূর্ব সেবা থেকে প্রসূতিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রসূতিরা মনে করেন, তারা সুস্থ রয়েছেন। এ অবস্থায় প্রসবপূর্ব সেবা নিতে হাসপাতাল বা মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।

Source: Bonik Barta

Share the Post: