প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও গর্ভকালীন সেবায় ঘাটতি: দেশে আবারো বেড়েছে মাতৃমৃত্যু

কয়েক দশকে দেশে মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উন্নতির ক্রমধারা দেখা গেছে। তবে ওই ক্রমধারার মধ্যে কোনো কোনো বছর আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি দেখা গেছে মাতৃমৃত্যু। চলতি দশকের শুরুতে সন্তান জন্ম দিতে যাওয়া মায়ের মৃত্যু বেড়েছে। দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্মের বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৬৮। যদিও আগের বছরগুলোয় তা কমতে শুরু করেছিল। মাতৃমৃত্যু বৃদ্ধির পেছনে কিশোরী গর্ভধারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা ব্যাহত হওয়ার মতো বিষয়গুলো রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মাতৃমৃত্যু বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রসূতিজনিত কারণে একজন নারীর গর্ভধারণ শেষ হওয়ার অর্থাৎ সন্তান জন্মদানের ৪২ দিনের মধ্যে মারা যাওয়াকে বোঝায়। গর্ভাবস্থা বা প্রসবের জটিলতা ছয় সপ্তাহের (৪২ দিন) প্রসবোত্তর সময়ের পরও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রতি এক লাখ প্রসবের বিপরীতে (শিশুর জন্ম) প্রসূতির মৃত্যুর অনুপাত মাতৃমৃত্যুতে দেখানো হয়।

চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (২০২২) প্রকাশ করে। এতে বছরভিত্তিক মাতৃমৃত্যুর চিত্র দেখানো হয়। গত সাড়ে তিন দশকের মাতৃমৃত্যু হারে ২০০২ ও ২০০৭ সালে মাতৃমৃত্যু আগের বছরের তুলনায় বেশি ছিল। আবার ২০২১ সালেও আগের বছরের তুলনায় মাতৃমৃত্যু বেশি দেখা যায়।

বিবিএস বলছে, ১৯৮৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর মাতৃমৃত্যু ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ১৯৮৬ সালে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মের বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ছিল ৬৪৮ জন। ২০০১ সালে এ অনুপাত ৩১৫ জনে নেমে এলেও ২০০২ সালে তা ৩৯১ জনে দাঁড়ায়। এরপর ২০০৬ সালে ৩৩৭ জন থাকলেও ২০০৭ সালে এসে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ছিল ৩৫১ জন। এর পর প্রতি বছরই মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমতে থাকে। ১৯৮৬ সাল থেকে যে ক্রমধারা দেখানো হয়েছে তাতে ৩৬ বছরের ব্যবধানে মাতৃমৃত্যু ৭৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠান।

মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উন্নতি রয়েছে উল্লেখ করলেও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলছে, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর উন্নতির পথে এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এগুলো হলো—অতি অল্পবয়সী প্রসূতি মায়ের মাতৃসংক্রান্ত জটিলতা, বাল্যবিবাহ ও পরবর্তীকালে গর্ভধারণ।

মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মাতৃমৃত্যু কমার ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও তাতে ধারাবাহিকতার ছন্দপতন হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রসূতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। মাতৃমৃত্যুর পেছনে বাল্যবিবাহ, কিশোরী গর্ভধারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী অব্যবস্থাপনা দায়ী। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কমেনি। দেশের প্রসূতিদের বড় একটি অংশ প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) পরিপূর্ণভাবে পাচ্ছেন না। একই ভাবে প্রসব পরবর্তী সেবা (পিএনসি) মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টায় এ সেবা দেয়া হয়। বাল্যবিবাহ ও কিশোর গর্ভধারণ (১৫-১৯ বছর বয়সে গর্ভধারণ) মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—গর্ভকালীন জটিলতা, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গর্ভকালীন জটিলতায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, প্রসবকালীন জটিলতায় ২৯, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে ২১, গর্ভপাতের জটিলতায় ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও বাকিদের অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক জরিপে (২০২২) বলেছে, অন্তত ২৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ঘটে প্রসবকালীন খিঁচুনিতে।

দেশে এখনো ৩৫ শতাংশ প্রসব অপ্রাতিষ্ঠানিক হয় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। সরকারের ওই প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০২২) প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, মোট প্রসবের ১৮ শতাংশ সরকারি, ৪৫ শতাংশ বেসকারি ও ২ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাতৃমৃত্যু বেড়েছে। ১৮ বছরর কম বয়সে এবং ৩০ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ করলে প্রসবের ক্ষেত্রে সেসব প্রসূতির ঝুঁকি বেশি থাকে। আমরা মাতৃমৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণগুলো জানি, কিন্তু পরোক্ষ কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো মাতৃমৃত্যু বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বাল্যবিবাহ, প্রসূতিদের সেবায় ঘাটতি। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও মৃত্যুর কারণ। অদক্ষ হাতে যেসব প্রসব হচ্ছে তাতে সংক্রমণ ঝুঁকি বেশি।’

এদিকে দেশে জন্ম নেয়া শিশুদের ২৫ শতাংশের জন্ম হচ্ছে অপ্রশিক্ষিত হাতে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এতে মাতৃমৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২০২১ সালে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৬৪ নবজাতকের জন্ম হয় নিজ বাড়িতে অদক্ষ ব্যক্তিদের হাতে। এ তথ্য শুধু ২০২১ সালে সারা দেশে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য সহকারীদের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করেছে অধিদপ্তর।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মো. মাহমুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যু হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর জন্য শুধু প্রসবকালীন ও পরবর্তী সেবার ঘাটতিই দায়ী নয়। এর পেছনে সচেতনতার অভাব, গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, বাল্যবিবাহ দায়ী। তবে সারা দেশে প্রসূতিসেবা দেয়ার জন্য সরকার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা রয়েছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাও কাজ করছে। মাতৃমৃত্যু প্রতি বছরই কমছে।’

অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও প্রসূতিসেবায় ঘাটতি থাকলে মাতৃমৃত্যু বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (মাতৃ, শিশু এবং কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবার-এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ) ডা. মো. নিজাম উদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনো ৪০ শতাংশ প্রসব অপ্রাতিষ্ঠানিক হচ্ছে। গর্ভবতীদের এবং গর্ভের সন্তান ও নবজাতক কোনো জটিলতার মধ্যে পড়লে যেন তার জন্য প্রস্তুতি নেয়া যায় তার জন্য এএনসি সেবা। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ মাতৃমৃত্যুকে বাড়ায়। সরকারের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় মাতৃমৃত্যু আগের তুলনায় কমেছে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: