শিশুর শারীরিক, মানসিক, মস্তিষ্কের গঠন, রোগ প্রতিরোধে মাতৃদুগ্ধ অপরিহার্য বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। তবে ফর্মুলা দুধকে মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপীই আইনবহির্ভূত বিপণন ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কাজে যুক্ত করা হচ্ছে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের। বিনিময়ে তাদের পকেটে ঢুকছে আয়ের একটা অংশ। আইনবহির্ভূত এ কার্যক্রম বেশি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশে, শিশুদের ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা। এতে প্রভাবিত হচ্ছেন প্রায় ৫৭ শতাংশ দুগ্ধদানকারী মা। ফলে নবজাতক ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে মাতৃদুদ্ধ খাওয়ানোর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।
পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের পর শাল দুধ ও ছয় মাস বয়স পর্যন্ত কেবল মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাবার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ সময় পানিরও দরকার নেই। ছয় মাসের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে ঘরে তৈরি সম্পূরক খাবার খাওয়াতে হবে। তবে এ নিয়মকে ভেঙে দিচ্ছে শিশুর খাদ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন কৌশলে ফর্মুলা দুধকেই তারা অপরিহার্য করে ফেলেছে। অথচ এসব খাবার সেসব শিশুর জন্যই প্রযোজ্য যারা মায়ের দুধ পায় না।
ফর্মুলা দুধের বিপণন কৌশল কীভাবে নবজাতককে মাতৃদুগ্ধ না খাওয়ানোর বিষয়ে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণা করেছে ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ। বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, চীন, মেক্সিকো, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনামের বিভিন্ন শহরের সাড়ে আট হাজার বাবা-মা ও গর্ভবতী নারীদের ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। এতে ৩০০ স্বাস্থ্য পেশাজীবীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণার ফলাফল নিয়ে ‘হাউ দ্য মার্কেটিং অব ফর্মুলা মিল্ক ইনফ্লুয়েন্স আওয়ার ডিসিশন অন ইনফ্যান্ট ফিডিং’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি বলছে, অর্ধেকের বেশি বা ৫৭ শতাংশ মাকে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দেয়া হয় স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মাধ্যমে। যদিও ৯৮ শতাংশ মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। গবেষণায় এও বলা হয়েছে, দেশের ২৭ শতাংশ দুগ্ধদানকারী মা বিভিন্ন মাধ্যমে ফর্মুলা দুধের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছেন। টেলিভিশন, স্থানীয় টেলিভিশন (কেবল টিভি) এবং ইউটিউব এতে মূল প্রভাবকের ভূমিকায় থেকেছে। প্রযুক্তিগত উত্কর্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফর্মুলা দুধের বিপণন বিজ্ঞাপনও সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলেছে। এতে মায়ের পাশাপাশি অন্যরাও শিশুর জন্য ফর্মুলা দুধের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে ফর্মুলা দুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কৌশলগত এ বিপণন কার্যক্রমের সরাসরি শিকার হচ্ছেন দুগ্ধদানকারী মা। কেননা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালে তিনি নিজেও অনেক জটিলতা থেকে দূরে থাকতে পারেন।
ইউনিসেফ বলছে, মায়ের দুধ শিশুদের প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। শৈশবকালীন অনেক সাধারণ অসুস্থতা এড়িয়ে যেতে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দুগ্ধদানকারী মায়ের ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এর পরও ফর্মুলা দুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বিপণন কৌশলের কারণে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি শিশু। গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার খুব সামান্য বাড়লেও ফর্মুলা দুধের বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে (৫৭ শতাংশ)। এরপর নাইজেরিয়ায় ৪৫ শতাংশ, মেক্সিকোয় ৪০, মরক্কোয় ৩৮, যুক্তরাজ্যে ৩০, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২২ ও চীনে ১৭ শতাংশ দুগ্ধদানকারী মা স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মাধ্যমে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর জন্য পরামর্শ পাচ্ছেন। মূলত প্রচারমূলক উপহার, বিনামূল্যের নমুনা, গবেষণার জন্য তহবিল, অর্থের বিনিময়ে মিটিং, ইভেন্ট, সম্মেলন আয়োজন এমনকি কমিশন প্রদানের মাধ্যমে নতুন মায়েদের ফর্মুলা খাদ্যের প্রতি আগ্রহী করতে পরামর্শ দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রভাবিত করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা যায়, সারা বিশ্বে শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় ডব্লিউএইচও সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত নীতিমালাটিকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ করে। আইনটির পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নতুন আইন করে সরকার। নতুন আইন অনুযায়ী, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য ও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা শিশুর বাড়তি খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি দায়ী প্রতিষ্ঠানকেও শাস্তির আওতায় আনা যাবে। এসব খাদ্য খেয়ে বা সরঞ্জামাদি ব্যবহারের কারণে কোনো শিশু অসুস্থ হলে বা মারা গেলে প্রস্তুতকারীর ১০ বছরের কারাদণ্ড হবে অথবা ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন হলে তাতেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড বিধান রয়েছে।
আইনটি বাস্তবায়নে কাজ করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন)। একমাত্র তারাই বিকল্প খাদ্য বিপণনের জন্য নিবন্ধন ও বিপণনের সামগ্রী ও বিষয়বস্তুর অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কাজ করে আইপিএইচএন। তবে ৫৭ শতাংশ মাকে স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দেয়ার তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন আইপিএইচএনের উপপরিচালক ডা. এবিএম মশিউল আলম। তার মতে, বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং ৬৫ শতাংশ। এরই মধ্যে সব জেলায় মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ ও মাতৃদুগ্ধ বিকল্প আইন বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে। সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে একটি গণআন্দোলনের চেষ্টা চলছে। মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি বাজারজাতকৃত শিশুখাদ্যে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরও এ আইনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বণিক বার্তাকে ডা. মশিউল আলম বলেন, শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের কাজ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেয়ার জন্য নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের একটা টোকেন নম্বর দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষণ শেষে নিবন্ধন দেয়া হবে। তবে দুধ বাজারজাত করতে হলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এবং আইপিএইচএনের লোগো ও নিবন্ধন নম্বর মোড়কে থাকতে হবে।
দেশের জনগণের পুষ্টি নিশ্চিতে সরকারের ২২ থেকে ২৪টি মন্ত্রণালয় কাজ করে। তাদের কার্যক্রমের সমন্বয়ের দায়িত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ। সংস্থাটির মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহিরয়ার কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ফর্মুলা দুধের বিপণনের বিষয়ে ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের উদ্বেগের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। পণ্যটি বিপণন ব্যবস্থার কৌশলের কারণেই আমাদের মায়েরা বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন। তারা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তবে মাতৃদুগ্ধের বিষয়ে সচেনতা বৃদ্ধি ও ফর্মুলা দুধের ক্ষেত্রে আইনগত বিষয়গুলো নিয়ে জেলা ও উপজেলায় আমাদের কার্যক্রম চলমান। প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কোনো চিকিৎসককে চাপ বা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা দুধকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তার পদক্ষেপ নেয়া আছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় যত দাপ্তরিক চিঠিপত্র সেগুলো মন্ত্রণালয়ে আমরা দিয়েছি।
ডব্লিউএইচও বলছে, শিশুদের মাতৃদুগ্ধ বাড়ানো গেলে বিশ্বে বছরে আট লাখ শিশুর মৃত্যু ঠেকানো যাবে। একই সঙ্গে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন ২০ হাজার মা। তবে নবজাতক ও শিশুর স্বাস্থ্যগত দিকগুলো অবমূল্যায়ন করে ফর্মুলা দুধ বিপণনের জন্য বিজ্ঞাপন দেয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. এস কে রায় বণিক বার্তাকে বলেন, বিপণন কৌশলের মাধ্যমে ফর্মুলা দুধকে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটি আইনত অপরাধ। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করা হয়েছে। গাইনোলজিস্টদের আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, তারা যেন মাতৃদুগ্ধের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করেন। আমরা পেশাজীবীদেরও সচেতন করেছি। যারা আইনের বিরুদ্ধে চলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করেছি। এমন চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ফর্মুলা দুধের কারণে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ দুধে মাতৃদুগ্ধের মতো পুষ্টিগুণ নেই।