দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন প্রকট রূপ নিয়েছিল, তখন দেখা দেয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা সংকট। সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসায় সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর জন্য রীতিমতো হাহাকার পড়ে। সে সময় বিশেষায়িত বা টারশিয়ারি বাদে মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাত্র কয়েকটিতে এ সুবিধা ছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে কিছু আইসিইউ ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা (এইচএফএনসি) যুক্ত করা হয়। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, লোকবল ও অক্সিজেনের অভাবে এসব জরুরি চিকিৎসা যন্ত্রের বেশির ভাগই অব্যবহূত রয়েছে। তেমনই একটি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। আইসিইউ ও এইচএফএনসি যুক্ত হওয়ার আড়াই বছর পেরোলেও লোকবল ও অক্সিজেনের অভাবে একদিনের জন্যও চালু করা যায়নি এসব সুবিধা। এ অবস্থায় হাসপাতালটির পক্ষ থেকে এসব সুবিধা ফেরত নিতে অনুরোধ জানানো হয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। তাতেও সাড়া মেলেনি।
রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালে হাসপাতালটির অবস্থান। ১৯৮৯ সালে শ্রমজীবী হাসপাতাল নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৯৭ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। এখন এটি পরিচালনা করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ধারণক্ষমতা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বাড়ানো হয়নি লোকবলসহ অন্যান্য কারিগরি সক্ষমতা। এমনকি ৫০ শয্যার হাসপাতালে যে-সংখ্যক লোকবলের প্রয়োজন তাও নেই।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কভিড মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালের জুলাইয়ে এ হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এরপর ২০২১ সালের শুরুতে স্থাপন করা হয় ১২ শয্যার হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা (অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, যা মিনিটে ৬০ লিটার বা তার বেশি অক্সিজেনের প্রবাহ দিতে সক্ষম)। এ দুই ওয়ার্ড চালু করার জন্য জনবল ও নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ পেতে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় চাহিদা জানানো হয়। তবে তাতে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছরের মে মাসে হাসপাতালের পরিচালক ডা. শামীম আল মামুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে যন্ত্রপাতি ফেরত নিতে চিঠি পাঠান।
সেখানে বলা হয়, ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের সাংগঠনিক কাঠামোয় আইসিইউর জন্য আলাদাভাবে জনবল বরাদ্দ নেই, নেই অক্সিজেন বরাদ্দের বাজেটও। ফলে নিজস্ব জনবল ও অর্থায়নে চালু করা যায়নি আইসিইউসহ হাই- ফ্লো ওয়ার্ড। দীর্ঘদিন অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে থাকায় এসব যন্ত্র কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে জনবল সংকটের কারণে রক্ষাণাবেক্ষণেও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক প্রায় ১২ ঘণ্টা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু রাখায় অর্থের অপচয় হচ্ছে।
তবে এ চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থাও। একই বছর সেপ্টেম্বরে আবারো স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে চিঠি পাঠান হাসপাতালের নতুন পরিচালক ডা. আম্মাতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা।
দুবার চিঠি পাঠালেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাড়া মেলেনি জানিয়ে ডা. আম্মাতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইসিইউ ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রক্ষাণাবেক্ষণ এখন হাতি পোষার মতো হয়ে গেছে। আমাদের এখানে লোকবলের সংকট রয়েছে। বিষয়টি আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানালে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ফেরত নেয়ার চিঠি দিতে বলেন। আমরা দুবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, তিনতলাবিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলায় আইসিইউ ওয়ার্ড তালাবদ্ধ। ভেতরে ভেন্টিলেটরসহ যাবতীয় সুবিধার পাঁচটি আইসিইউ শয্যা। শয্যাগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায়, গুরুত্বপূর্ণ এ ওয়ার্ডে কখনো রোগী ছিল না। পাশেই হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ওয়ার্ড। ১২ শয্যার এ ওয়ার্ডে রয়েছে আধুনিক সব সুবিধা। তবে এটিও একদিনের জন্য চালু হয়নি।
এ দুটি বিশেষায়িত সেবার ওয়ার্ড ছাড়া হাসপাতালটির সার্বিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। রয়েছে জনবলসহ নানা সংকট। এর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া আইসিইউ ও এইচএফএনসি রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানটির কাজকে আরো কঠিন করে দিয়েছে। ফলে এসব ফেরত পাঠানোই কর্তৃপক্ষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইসিইউ ও এইচএফএনসি ফেরত নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে অন্য কোথাও চাহিদা আছে কিনা তা জেনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কোনো ধরনের পরিকল্পনা বা সক্ষমতা যাচাই না করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় চাপে পড়ে হাসপাতালগুলোয় জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠায় বলে উল্লেখ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘শুধু একটি হাসপাতাল নয়। খুঁজলে বিভিন্ন হাসপাতালে এমন অসংখ্য জরুরি যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে, যা ব্যবহার হচ্ছে না। দেয়ার আগে অবশ্যই লোকবল ও হাসপাতালের সক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই করা উচিত। না থাকলে ব্যবস্থা করা উচিত। মন্ত্রণালয় যখনই চাপে পড়ে তখনই যাচাই না করে তড়িঘড়ি করে যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দেয়। এখন ওই যন্ত্রপাতি এনে অন্য কোথাও বসিয়ে চালু করলে দেখা যাবে, অনেকগুলো অচল হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয়ের ওপর থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত কাজে অব্যবস্থাপনা দেখা যায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই এমন হচ্ছে।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখানে ৫০ শয্যার জন্য যে লোকবল ছিল তার অর্গানোগ্রাম (সাংগঠনিক কাঠামো) পরিবর্তন করা হয়নি। ওই পুরনো অর্গানোগ্রামে ৩১ চিকিৎসকের মধ্যে রয়েছেন ২২ জন, ৩১ নার্সের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ছয়জন। ১৫০ শয্যার হাসপাতাল চালানোর জন্য এখানে অন্তত ৭০ জন নার্স প্রয়োজন। পুরনো অর্গানোগ্রামের ১৬৬ জন লোকবলের বিপরীতে কর্মরত ৭১ জন। সিটি করপোরেশনের নতুন বিধিমালায় ২০১২ সাল থেকে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ফলে চিকিৎসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে আনতে হয়। এতে সৃষ্টি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোগীকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দেয়া হয়। সংকট নিরসন হলে এ হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবায় আরো ভূমিকা রাখতে পারবে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে সরকারিভাবে স্বল্প মূল্যে প্রায় ৩০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালে দৈনিক গড়ে রোগী ভর্তি থাকে ৩০-৪০ জন। গত বছর বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য এসেছে প্রায় ৭০ হাজার রোগী। ভর্তি ছিল প্রায় আট হাজার এবং অস্ত্রোপচার হয়েছে ১৭৪ জনের। রোগীদের প্রায় ৭০ প্রকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়।