দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। অত্যাধুনিক সব যন্ত্র ও গবেষণানির্ভর হওয়ায় চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী প্রতিষ্ঠানটিতে ভিড় করে। সেখান থেকে আয়ের (ইউজার ফি) নির্দিষ্ট অংশ শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের রেওয়াজ। তবে নির্দিষ্ট কমিশনের অতিরিক্ত ১২৬ কোটি টাকা ভাগাভাগি হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে সেই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে ফেরতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত লভ্যাংশ বিলি-বণ্টনে নিষেধাজ্ঞা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এদিকে আদালতের রায়ের চার বছরেও ফেরত দেয়া হয়নি অতিরিক্ত সেই অর্থ। উল্টো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লভ্যাংশের নামে সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে পাওয়া আয়ের টাকা বিভাগের ব্যাংক হিসাবে জমা করে সেখান থেকেই তুলে নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনুমোদন নেয়া হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি এবং অর্থ ও হিসাব শাখার।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রোগ পরীক্ষা বাবদ আসা অর্থ বিভিন্ন রিএজেন্ট, পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট খরচ বাদ দিয়ে লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ চিকিৎসক-কর্মচারীদের মাঝে বণ্টনের বিষয়টি ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫তম সিন্ডিকেটে তোলা হয়। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, প্রচলিত সব খরচ বাদ দিয়ে লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, নার্স ও কর্মচারীরা পাবেন। সেই অর্থের মধ্যে ৬০ শতাংশ পাবেন শিক্ষক ও চিকিৎসকরা। বাকি ৪০ শতাংশ ভাগ করা হবে অন্যদের মাঝে। যদিও বিভাগগুলো সেই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ করে ভাগাভাগি শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। সে আলোকেই যেসব বিভাগ লাভ্যাংশের নির্দিষ্ট হারের বেশি অর্থ নিয়েছে তাদের তা ফেরত দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল হান্নান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে অতিরিক্ত অর্থ জমা দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে ইউজার ফি নেয়া বিভাগগুলোকে অর্থবছর শেষে লাভ-ক্ষতির হিসাব ও মুনাফা নির্ধারণ এবং ২০০৭ সাল থেকে আদেশ জারির সময় পর্যন্ত নেয়া অতিরিক্ত অর্থের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত লভ্যাংশ বণ্টন স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি ইউজার ফি থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নেয়া অতিরিক্ত টাকা নির্ধারণে একটি কমিটি করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নানা অনুসন্ধান শেষে ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রতিবেদন জমা দেয় সেই কমিটি।
এতে দেখা যায়, ২০০৬-০৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বিভাগ ইউজার ফি বাবদ মোট আয় করে ৭৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪২৯ কোটি ৬০ লাখ। সে হিসাবে লভ্যাংশ ছিল ৩২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৮৩ কোটি টাকার মধ্যে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রাপ্য ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ অন্যরা নিয়েছেন ২০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকারও বেশি। অর্থাৎ অতিরিক্ত নেয়া হয় ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখা জানিয়েছে, ‘ইউজার ফি’ নামে রোগীদের থেকে প্রাপ্য আয়ের অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। তবে কত টাকা আয় ও ব্যয় হচ্ছে তা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো হয় না। এর মধ্য থেকে কত টাকা কমিশন বাবদ নেয়া হচ্ছে সে বিষয়েও অবগত নয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা জানান, শুধু হেমাটোলজি বিভাগ নয়, প্রায় সব বিভাগের একাধিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে। রোগ পরীক্ষা বাবদ আসা অর্থ তাতে জমা নেয়া হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি, অর্থ ও হিসাব শাখার অনুমোদন না নিয়েই তা খরচ করা হচ্ছে। ইউজার ফি থেকে লভ্যাংশ নেয়ার বিষয়টি কাগজে-কলমে স্থগিত করা হলেও বিভাগগুলো তা নেয়া বন্ধ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগ পরিচালিত একটি ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্টে দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চে ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা উত্তলন করা হয়েছে। ওই সময় জমা ছিল প্রায় ২ কোটি টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাউদ্দীন শাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউজার ফি থেকে অন্যান্য বিভাগ লভ্যাংশ নিচ্ছে কিনা আমরা আগে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিই। আগে রেওয়াজ অনুযায়ী নেয়া হচ্ছিল। তবে সিন্ডিকেট নতুনভাবে বণ্টনের নিয়ম করেছে।’
ইউজার ফির লভ্যাংশ বণ্টনের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। সাবেক এ উপাচার্য বণিক বার্তাকে জানান, আদালতের নির্দেশনার আলোকে তত্কালীন প্রশাসন এক বা একাধিক কমিটি করেছিল। সে কমিটিগুলোর সুপারিশের আলোকে সিন্ডিকেটে কিছু কিছু অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া অবশ্য বলেন, ‘সব বিভাগকেই হিসাব-নিকাশ দিতে হবে। অতিরিক্ত ওই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। বিভাগগুলোকে অবশ্যই কেন্দ্রীয় হিসাবে টাকা জমা দিতে হবে। আয়ের এ অর্থ পাবলিক মানি। তাই কে কত নিচ্ছে তার বিষয়েও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির দুজন সদস্য জানান, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে বলা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যায়, যারা অর্থ নিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে চাকরিতে বহাল নেই, কেউ কেউ মারাও গেছেন। তাই পরবর্তী সময়ে আর টাকা ফেরতের বিষয়টি সুরহা হয়নি। তবে বিভাগগুলো নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে যেভাবে ইউজার ফি জমা রাখছে, তা নিয়মবহির্ভূত। কেননা এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের টাকা। অর্থ কমিটির অনুমোদন ও পরামর্শ ছাড়া সে অর্থ ব্যয়েরও সুযোগ নেই। কিন্তু তা পরিপূর্ণভাবে মানা হচ্ছে না। আবার এও দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ফাঁকা কিন্তু বিভাগের হিসাবে কোটি কোটি টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও অর্থ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল একটি। বিভাগের অর্থ কেন্দ্রীয় হিসাবে জমা দেয়ার জন্য অর্থ কমিটির পক্ষ থেকে সিন্ডিকেটকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতাল জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। কোনো বিভাগ অর্থ ব্যয় করলে তাতে অবশ্যই কেন্দ্রীয় অর্থ কমিটির অনুমোদন লাগবে। একই সঙ্গে ইউজার ফি থেকে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরতের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে লভ্যাংশ বণ্টন করা যাবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো বিভাগ নেয়া বহাল রেখেছে কিনা তা তদন্তের বিষয়। লভ্যাংশ নিলে সেসব ব্যক্তি বাইরে প্র্যাকটিস করতে পারবেন না।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, হাইকোর্টের রায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজার ফি থেকে লভ্যাংশ নেয়ার বিষয়টির কোনো সুরহা হয়নি। তবে সম্প্রতি এক সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ১৫ শতাংশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি কর্মরতরা পাবেন ১৫ শতাংশ। তবে তা মূল বেতনের দ্বিগুণের বেশি হতে পারবে না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগ রয়েছে, যেখানো রোগ নির্ণয় হয় না। ফলে কাজ করলেও লভ্যাংশের অর্থ পান না সেই বিভাগে কর্মরতরা। তাই ইউজার ফির লভ্যাংশ ঝুঁকি ভাতা হিসেবে বণ্টনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে যারা এ অর্থ নেবেন তারা আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়োজিতদের অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে রাত-দিন কাজ করেন। অনেক সময় সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকে। কেউ কেউ চিকিৎসা ও রোগ নিরীক্ষা করতে গিয়ে রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বিদেশে থাকায় তার দায়িত্বে রয়েছেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে গেলে তিনি অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) গৌর কুমার মিত্রকে নিজ কার্যালয়ে ডাকেন। গৌর মিত্র বণিক বার্তাকে জানান, বিভাগের হিসাব সম্পর্কে অর্থ শাখা অবগত নয়। বিভাগগুলোকে বার্ষিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব দিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইউজার ফির বিষয়টি ঝুঁকি ভাতা হিসেবে নির্দিষ্ট হারে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।