গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকের বেশি। দূর করা যায়নি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের ২১ শতাংশ মানুষ। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, বান্দরবান, কক্সবাজার ও জামালপুর—এ ছয় জেলায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। এসব জেলার খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ।
দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রাম। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। প্রতি বছর একটি বড় সময় ধরে বন্যাকবলিত থাকে জেলাটি। এ সময় জেলার দারিদ্র্যপীড়িত বাসিন্দাদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা গুরুতর হয়ে দেখা দেয়। টানা ১০ বছর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, বন্যার প্রভাবে চার মাস বা তারও বেশি সময় প্রতিদিন গড়ে অন্তত একবেলা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাবার খেতে পায় না জেলার প্রায় ২০ শতাংশ বাসিন্দা। এ সময় মোটাদাগে দিনের অন্যান্য বেলায়ও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম থাকে। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাবারের প্রাপ্যতা না থাকায় এসব মানুষ ভোগে অপুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা অসুস্থতায়। শিশুরাও বেড়ে ওঠে পুষ্টিহীন ও খর্বকায় হয়ে।
বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ সরকার এবং ৩১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত এ গবেষণায় অর্থায়ন করেছে ইউএসএআইডি। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্ট’ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে। এতে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। প্রথম স্তরের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বলতে বোঝানো হয়েছে সারা বছর গ্রহণযোগ্য মাত্রায় মানসম্মত খাদ্যের প্রাপ্যতাকে। পর্যাপ্ত মাত্রায় খাদ্যের প্রাপ্যতা থাকলেও এর মানসম্মততার অভাব থাকলে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে দ্বিতীয় স্তরের বা মৃদু খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা হিসেবে। বছরে দু-চার মাস দিনে গড়ে একবেলা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাদ্যের অভাবকে তৃতীয় স্তরের বা মধ্যম মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বছরে চার মাস বা তার বেশি সময় দিনে একবেলা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাদ্যের অভাবকে বর্ণনা করা হয়েছে চতুর্থ স্তরের বা গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা হিসেবে।
আইপিসির হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কুড়িগ্রাম। নিম্ন আয় ও উচ্চদারিদ্র্যের প্রভাব এবং বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব এখানকার বাসিন্দাদের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ও গুণগত মানে প্রভাব ফেলছে। জেলার প্রায় সাড়ে চার লাখ বা ২০ শতাংশ মানুষ বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বছরের চার মাসের বেশি সময় খাদ্য সংকট পড়ে। এ সময় প্রতিদিন অন্তত একবেলা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাবারের অভাবে ভোগে তারা (গুরুতর বা চতুর্থ স্তরের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা)। এসব পরিবারের সদস্যরা অপুষ্টি ও শিশুরা খর্বাকৃতির ঝুঁকিতে রয়েছে। একই সঙ্গে জেলার আরো ২০ শতাংশ মানুষ মধ্যম বা তৃতীয় স্তরের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বছরের দু-চার মাস দিনে অন্তত একবেলা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। জেলাটিতে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার প্রধান ভুক্তভোগী নারীরা। কুড়িগ্রামের ৭৫ শতাংশ নারী পর্যাপ্ত বৈচিত্র্যের খাবার খেতে পারছে না।
আইপিসির তথ্যে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম আকতারুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমরা ১০ বছর আগে এমন একটি জরিপ করেছিলাম। যেখানে ২১-২৩ শতাংশ মানুষ মধ্যম ও গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল। এর মধ্যে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল ১১ শতাংশ। আইপিসির তথ্যেও এমনটি বলা হচ্ছে। দেশে প্রচুর খাদ্যোৎপাদন হলেও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাও রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ের ভারসাম্যহীনতাও রয়েছে। মানুষের আয় অপর্যাপ্ত, অনেকে শ্রমের ন্যায্যমূল্য পায় না। এমনকি কোনো অঞ্চলের মানুষ নিপীড়নের শিকারও হচ্ছে। এসব বিষয় স্বাভাবিকভাবে খাদ্য ক্রয় ও গ্রহণে প্রভাব ফেলে। এতে বাড়ছে অপুষ্টি ও রোগ।
কুড়িগ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও নদীভাঙন, দুর্বল মানবসম্পদ ও ভৌত সম্পদের অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব প্রভাবকের কারণে জেলাটির বাসিন্দাদের নানা ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে। শ্রমিকের স্বল্প উপার্জন ও টেকসই আয়ের উৎস না থাকা, অদক্ষ শ্রমসম্পদ এবং সনাতন পদ্ধতির কৃষি ও মত্স্য আহরণসহ বেশকিছু প্রভাবক জেলার অনেক পরিবারকেই এখন নাজুক অবস্থানে ফেলে দিয়েছে।
আইপিসির হিসাব অনুযায়ী, কুড়িগ্রামের প্রায় সাত লাখ মানুষ বা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণ করতে পারলেও তা মানসম্মত নয়। এসব মানুষের আয় ও ব্যয় প্রায় কাছাকাছি থাকায় তারা মৃদু খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় (দ্বিতীয় স্তর) ভুগছে। তাদের প্রতিঘাত সামাল দেয়ার সক্ষমতাও সীমিত। পর্যাপ্ত মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে পারছে বাকি ৩০ শতাংশ।
প্রায় প্রতি বছরই পুরো কুড়িগ্রাম মারাত্মক বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়ে। এতে ফসলি জমি ও রাস্তাসহ নানা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই জেলাটির বাসিন্দাদের দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের হয় একেবারে ভূমির মালিকানা নেই বা থাকলেও তা পাঁচ ডেসিমলের কম। চলতি বছরও বন্যায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে কুড়িগ্রাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে গতকাল পর্যন্ত বন্যায় জেলার নয়টি উপজেলার সবাই দুর্গত হয়েছে। আর ৭৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪২টিরই বাসিন্দারা বন্যাকবলিত হয়েছে। সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতায় পড়েছে জেলার অনেক বাসিন্দা।
যদিও জেলার কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ আগের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের গবেষণাও ফলপ্রসূ হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে খাদ্যে উদ্বৃত্তের জেলায় পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (কুড়িগ্রাম) ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. শামসুদ্দিন মিঞা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, জেলায় এখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। শুধু ধানই নয়, অন্যান্য শস্যেরও উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এখানে নতুন নতুন জাতেরও উৎপাদন বাড়ছে। যদিও এখানে নদীভাঙন, নতুন চর সৃষ্টি হওয়া, বন্যা ও খরার সমস্যা রয়েছে। এর পরও কুড়িগ্রামে খাদ্যে কোনো ঘাটতি নেই। একদম নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়িতেও ৫-১০ মণ ধান আছে। মানুষের কর্মদক্ষতা ও কাজের পরিধি বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে তেলশস্য, আলু ও শাকসবজির উৎপাদন। সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত আইপিসির প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণা করা যাবে না।
কুড়িগ্রামসহ দেশের ছয় জেলার ৩৫ শতাংশ মানুষ এখন তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে আইপিসির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে অন্য জেলাগুলো হলো সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, বান্দরবান, কক্সবাজার ও জামালপুর। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশ অনেকাংশেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে যেসব জেলার কৃষিতে ব্যবস্থাপনাগত ঘাটতি প্রকট, সেসব জেলায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেশি দেখা যায়। আবার সব জেলার কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা এক রকম নয়। এলাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সম্পদ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা ভিন্ন হয়। তবে বাংলাদেশে সে ধরনের ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আইপিসি ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত চিত্র তুলে ধরেছে। করোনা মহামারীর কারণে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা রয়েছে এমনটি বলা হলেও আমদানি কমেনি। চাল, ডাল, পেঁয়াজ ভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। কোনো দেশ যদি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে গোটা খাদ্যনিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শুধু চাল বা ডালের ওপর নির্ভরশীলতা নয়, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সব শ্রেণীর খাদ্যোৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির সঙ্গে শিক্ষা ও সচেতনতার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত।
কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি বেড়েছে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। সংস্থাটির এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দামে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এ ভারসাম্যহীনতায় আরো প্রভাব ফেলেছে। এতে উন্নয়নশীল দেশ ও তাদের উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের হারে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশেও খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের সমতা নষ্টের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে গ্রামীণ খানাগুলোয় খাদ্যের পেছনে ব্যয় কমিয়ে পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।