করোনা মহামারীর মধ্যে চলতি বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশে প্রায় দুই যুগে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাসে চলতি বছরই সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে। বছরের প্রথম ছয় মাসে মৃত্যুর হার ছিল শূন্য। এরপর মৃত্যু বৃদ্ধি পায়। এক বছরের মৃত্যুর ৮০ শতাংশের বেশিই হয়েছে শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর)। মৃত্যুর এ ক্রমধারা আগামী বছরের শুরুর কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৬১ হাজার ৬৮১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৩৯ হাজারের কিছু বেশি এবং ঢাকার বাইরে প্রায় ২৩ হাজার। চলতি বছরই ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মারা গেছে। গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২৮১ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে মারা গেছে ১৭৩ জন।
দেশে চলতি বছরই সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শুরু থেকেই এডিস মশা নির্মূল, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার কাজ করছে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলে অভিযোগ কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। শুধু মৌসুমি কার্যক্রমের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না এলে অবস্থার উন্নতি হবে না বলে মনে করছেন তারা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সরকারের তথ্য বলছে, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ২২৬ জনের মৃত্যু হয়। ডিসেম্বরে মারা গেছে ২৭ জন। অক্টোবর থেকে প্রায় প্রতিদিন হাজারের কাছাকাছি রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছিল। এরপর ডিসেম্বরে এসে আক্রান্ত হার ও মৃত্যু সংখ্যা কিছুটা কমতে থাকে। তবে তা সন্তোষজনক পর্যায়ে নামেনি বলে মনে করেন রোগতত্ত্ববিদরা।
ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৌসুমি সময় ছাড়াও আমরা ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি। শীতে ডেঙ্গু রোগী পাব না তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত সেভাবে বা সে প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম হয়নি। শুধু কীটনাশক দিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও রোগতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে নীতিনির্ধারণ করতে হবে। চলতি বছরের ক্রমধারায় আগামী বছর কেমন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হতে পারে এবং মারা যেতে পারে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, আগামী বছর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।’
দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে। সে সময় দেশের সব ক’টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। ওই সময় লক্ষাধিক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়, আর মারা যায় প্রায় ২০০।
জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঢাকার হাসপাতালগুলোর ভালো ভূমিকা থাকলেও রাজধানীর বাইরের চিকিৎসার চিত্র ছিল আলাদা। এর আগে ঢাকার বাইরে এত বেশি ডেঙ্গুর সংক্রমণ বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ফলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের পক্ষে ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিল না যথাযথ সুবিধাও। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ রোগী ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকার বিভাগ মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, বিশ্বে ১৭৮০ সালে প্রথম ডেঙ্গু মহামারী দেখা দেয়। যদিও ১৬০০ সালেও ডেঙ্গু রোগীর অস্তিত্ব ছিল। এরপর ১৯৫০ সালে এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়ায়। পরে ১৯৬৩ সালে ভারতের কলকাতা এবং ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ মেলে। সে সময় ডেঙ্গুকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়। মূলত ২০০০ সালে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ডেঙ্গুকে রোগ হিসেবে দেখা হয়। সে বছরই সাড়ে পাঁচ হাজার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেও তাদের সংক্রমণের কারণ এডিস এজিপটা মশা ছিল। তবে এডিস অ্যালবোপিকটাস চট্টগ্রামে সংক্রমণ ঘটায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কেন এ বছর বেশি মৃত্যু হয়েছে তা বলা মুশকিল। যারা মারা গেছে তাদের রোগের ইতিহাস জানা নেই। এর আগে ডেঙ্গু বা অন্য কোনো সংক্রমণ তাদের ছিল কিনা তা অজানা। আর যথাযথ সুবিধা ও লোকবলের অভাবে আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বা মৃত্যুর হিসাব হাসপাতালভিত্তিক হয়ে থাকে।’