স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে ফেনীর মানুষ। সব স্থাপনার মতোই পানি ওঠে ২৫০ শয্যা ফেনী জেনারেল হাসপাতালেও। তলিয়ে যায় নিচতলায় থাকা নবজাতক শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, স্টোর রুম, ডায়ালাইসিস ইউনিট, ডেন্টাল ইউনিটের সরঞ্জাম। নৌকায় করে চলাচল করতে হয় হাসপাতাল চত্বরে। জরুরি বিভাগের কার্যক্রম নিচতলা থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় তলায় নেয়া হলেও বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। ফলে সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিঘ্নিত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। বর্তমানে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে হাসপাতালে ক্ষয়ক্ষতিও।
কেবল ফেনীই নয়, প্রবল বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১১টি জেলার ৬৮ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত হয় অন্তত অর্ধ কোটি মানুষ। প্লাবিত হয়েছে এসব অঞ্চলের ৫৪২টি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে নানা সংকট, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা। পরিপূর্ণভাবে সেবা পাওয়ার জন্য স্থানীয়দের আরো এক থেকে দুই সপ্তাহের বেশি সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ, ছয়জন নারী ও সাত শিশু। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ফেনীতে, ১৭ জন। এছাড়া কুমিল্লায় ১৪, নোয়াখালীতে ৮, চট্টগ্রামে ৬, কক্সবাজারে ৩ এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে বন্যার কারণে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বন্যাকবলিত এলাকায় ৫৪২টি সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জেলা সদর বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন হওয়ায় সে হিসাব দিতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নকারী সরকারের এ প্রতিষ্ঠান। তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ৩ হাজার ১৪৫টি। এর মধ্যে ৫২৫টি প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ফেনীর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ জেলায় ১৮৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭১টিই প্লাবিত হয়েছে। এরপর নোয়াখালী জেলায় ৩৪১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্লাবিত হয়েছে ১৩৭টি। কুমিল্লায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৬৪টি, যার মধ্যে ১১৯টি প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে ৬২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫০টি, লক্ষ্মীপুরে ২০৬টির মধ্যে ৩৫টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৬৪টির মধ্যে পাঁচটি এবং কক্সবাজারে ২১৪টি ও খাগড়াছড়ির ১২২টির মধ্যে চারটি করে আটটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। আর সিলেট বিভাগের চার জেলায় ১ হাজার ১১টি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মধ্যে মৌলভীবাজারে ১৫টি প্লাবিত হয়েছে ও হবিগঞ্জে দুটি।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনীতে ছয় উপজেলার মধ্যে ফুলগাজী ও পরশুরামের পানি নামতে শুরু করেছে। সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা, ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যার পানি নামছে অনেকটা ধীরগতিতে। সদর বাদে বাকি পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি চিকিৎসা কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে। আর আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা থেকে পানি নেমে গেলেও ডায়ালাইসিস, দন্ত্য ও শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি এখনো। বন্যার পানি হাসপাতালটির নিচতলায় চার থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত উঠেছিল। ফলে নষ্ট হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম। জেলাটিতে রয়েছে চিকিৎসকের সংকট। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসক পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়।
এদিকে জেলার প্রায় সব কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এখনো পানিতে ডুবে আছে। জেলায় সরকারের ৭৬টি মেডিকেল টিম রাখা হলেও সব অঞ্চলে তাদের পাঠানো যায়নি বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. মো. শিহাব উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত তিনদিন ফেনী জেনারেল হাসপাতালটির কার্যক্রম চালুর চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদিও এ হাসপাতাল আমার অধীনে নয়। ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হওয়ায় তা উপপরিচালক পর্যায়ে একজন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে থাকে। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা প্রথম সাতদিন পানিবন্দি থাকায় আসতে পারেননি। মঙ্গলবার এলেও অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও আমরা চালু করেছি। তবে পানি থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো এখনো চালু করা যায়নি। মেডিকেল টিমও পর্যাপ্ত নয়, যা রয়েছে তা সব জায়গায় অ্যাকটিভ করতে পারিনি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ থাকলেও সিএইচসিপি (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রাভাইডার) বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ দিচ্ছে। নার্স ও চিকিৎসকরা বুধবার থেকে স্টেশনে রয়েছেন।’
এদিকে নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে সদর, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, সেনবাগ ও কবিরহাটের শতভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আর কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর, চাটখিল উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলগুলো। হাতিয়া উপজেলা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ও মেঘনা নদীর মোহনায় হওয়ায় সেখানে বন্যা হয়নি। জেলার প্লাবিত ইউনিয়নগুলোয় কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র পানিতে তলিয়েছে। ফলে সেগুলো এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। জেলার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মানুষ আসছে জরুরি চিকিৎসার জন্য।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বণিক বার্তাকে জানান, জেলার সাতটি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ও ১৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্লাবিত হয়েছে। জেনারেল হাসপাতাল ও আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সব চালু রয়েছে। যেসব হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ নেই। তবে প্রতিরোধমূলক সেবা বা প্রথমিক চিকিৎসাসেবার কেন্দ্রগুলো প্লাবিত হওয়া বন্ধ রয়েছে। এ জেলায় চিকিৎসাসেবা দিতে ১২৪টি মেডিকেল টিম রয়েছে।
বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় অনেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় সেবা দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচলক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। সার্বিক বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ভালো খবর হলো ফেনীতে অনেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে আমরা চালু করতে পেরেছি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে গেলেও ময়লা-আবর্জনা রয়েছে। তা পরিষ্কার করে সেবা চালুর চেষ্টা করছি। বলতে পারেন, রিস্টোরেশন শুরু করেছি। আমাদের চিকিৎসকরা যারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়েছিলেন তারা এখন পুরোদমে কাজ করছেন। এখন নোয়াখালীর দিকে পানি বেড়েছে। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো থেকে পানি নেমে গেলে সেবা কার্যক্রম চালু করা যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পানি পুরোপুরি নেমে গেলে বন্যা-পরবর্তী রোগ বাড়বে। তার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে। তাছাড়া বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কী কী ক্ষতি হয়েছে এর একটা তালিকা করে পাঠাতে বলেছি সিভিল সার্জনদের।’