বন্যা ও খরার প্রভাব: খাদ্যাভাবে জামালপুরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ

উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য আর পশ্চিমে যমুনা নদীর তীরঘেঁষা জেলা জামালপুর। এ জেলার ৯২ শতাংশই কৃষক পরিবার। এখানে মোট খাদ্যশস্য উত্পন্ন হয় সাড়ে ১০ লাখ টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও প্রায় পাঁচ লাখ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকে। তবে মারাত্মক বন্যাপ্রবণ হওয়ায় এ জেলায় প্রতি বছরই এক-চতুর্থাংশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একটি জনগোষ্ঠী খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হয়। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়ে জেলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ।

চলতি বছর উজান থেকে নেমে আসা পানি ও অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় সাত উপজেলার সবক’টিতে ফসলের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ছিল, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে রোপা আমন বীজতলা, আউশ, পাট, সবজি, মরিচ, ভুট্টা, তিল ও কলা। এতে বিপর্যয়ে পড়ে প্রায় ৫০ হাজার কৃষক পরিবার বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি বিভাগ।

দুর্যোগপ্রবণ জামালপুরের কৃষকরা প্রতি বছর মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে জানান বেসরকারি সংস্থা ‘উন্নয়ন সংঘ’র নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল আলম মোল্লা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শুধু বন্যা নয়, খরা ও নদীভাঙনের কারণেও এ জেলার কৃষক প্রতি বছর মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন। তবে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষিজীবীরা। ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি গৃহপালিত পশু-পাখি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে এ জেলার মানুষ। মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত দুর্যোগ বেশি হয়। ফলে বছরের এ সময়টায় মানুষ প্রয়োজনীয় খাবারের সংস্থান করতে পারে না। সরকারের দেয়া সহায়তাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে অনেকটাই অর্ধাহারে থাকে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জামালপুরের কার্যালয় বলছে, বন্যাকবলিত জামালপুরের সাড়ে পাঁচ লাখের কিছু বেশি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে সোয়া পাঁচ লাখ পরিবার কৃষিনির্ভর, যা মোট গৃহস্থের ৯২ শতাংশ। এ জেলার কৃষকদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ প্রান্তিক ও ১১ শতাংশ ভূমিহীন। জেলায় আবাদযোগ্য দেড় লাখ হেক্টর জমিতে এক থেকে তিনের অধিক ফসলের চাষাবাদ হয়। তবে সব জমিতে সমানভাবে ফসল উৎপাদন হয় না। একফসলি থেকে চারফসলি পর্যন্ত জমির পরিমাণ হিসেবে জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। আবাদযোগ্য দেড় লাখ হেক্টরের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ জমি সাধারণত বন্যাকবলিত হয় না। বাকি জমিগুলো তিন-নয় ফুট পর্যন্ত বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়।

বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) বলছে, গুরুতর ও মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় অন্যতম জেলা জামালপুর। জেলায় ১৫ শতাংশ বা সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব মানুষ বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় একবেলা খাবার নিয়ে সংকটে ভুগছে। আর ২০ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এসব মানুষ বছরের দুই-চার মাস একবেলা খাবারের অভাবে থাকে।

আইপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছর ২০-৪০ শতাংশ জামালপুরবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ২০১৯ সালে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ সময় প্রায় ৯৪ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের উৎস ও সম্পদ হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে। প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রয়েছে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে। ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের উৎস টেকসই না হওয়ায় দারিদ্র্যের স্থায়িত্ব ও দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এতে খাদ্যের প্রাপ্যতা ও ব্যবস্থাপনায় প্রভাব পড়ছে। ফলে ৩৩ শতাংশ শিশু রয়েছে খর্বাকৃতির ঝুঁকিতে। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করেছে সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়েছে, প্রকৃতিগত বিপর্যয় যেমন বারবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, দুর্বল মানবসম্পদ ও ভৌত সম্পদের অপর্যাপ্ততা দেশে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (জামালপুর) ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোছা. জাকিয়া সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষকদের অতিরিক্ত চাষ করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়া হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকার চাষীরা চারা বিক্রি করে আয় করেন। উঁচু জমিগুলোর কৃষকদেরও চারা উৎপাদন করার জন্য বলা হচ্ছে। শুকনো বীজতলা উৎপাদন নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যেন অল্প জায়গায় বেশি বীজ উত্পন্ন হয়। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাসিন্দাদের বাড়ির আঙিনা বা ছাদে চাষের জন্য বলছি। দুই ফসলের জায়গায় তিনফসলি জমি করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, আমরা কৃষকদের আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। প্রতি বছরই একটা বরাদ্দ রাখা হয় বন্যা, খরা প্রতিরোধ করার জন্য। আমনের মৌসুমের জন্য এরই মধ্যে সারা দেশে কৃষি প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। বীজ, সার এগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা উচ্চফলনশীল যেসব জাত আছে সেগুলো উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি। নতুন কিছু আধুনিক জাত এসেছে, এগুলো প্রচুর ফলন দেয়। আমরা সেগুলো কৃষকদের থেকে কিনে নিচ্ছি। আবার পরবর্তী সময়ে কৃষকদের কাছে সরবরাহ করব।

তবে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন বলে মনে করেন সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দির মাহমুদ। তার মতে, খাদ্যনিরাপত্তা আগের চেয়ে বাড়লেও তা এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের বিষয়টি নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। সরকার বিভিন্ন কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছে। তবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে আরো বেশি সমন্বয় করতে হবে। প্রাধান্যের ভিত্তিতে যেসব জেলায় স্বল্পতা বেশি সে এলাকাগুলোয় বেশি নজর দিতে হবে। পরিকল্পনা করে এগিয়ে গেলে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার মতো সারা দেশের খাদ্যনিরাত্তাহীনতাও কাটিয়ে ওঠা যাবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দ্বিতীয় পুষ্টি পরিকল্পনায় পরিবারগুলোকে নিজস্ব উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ন্যূনতম জমিও খালি না থাকে এমন কার্যক্রম বিভিন্ন সময় নেয়া হয়েছিল। পুকুরে মাছ চাষের জন্য ভালো জাতের পোনা, খালি জায়গাগুলোয় রোপণের জন্য বিভিন্ন ফলদ চারা সরবরাহ করা হয়েছে। পোলট্রি মুরগি, হাঁস ও গবাদিপশু পালনের জন্য আলাদাভাবে অর্থায়ন করা হয়েছে। আশা করা যায় এর মাধ্যমে পুষ্টি পরিকল্পনা সফল হবে।

বাংলাদেশ ক্যালরির প্রাপ্যতার দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০০০ সালে দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিজে বাস করলেও ২০১৯ সালে এ হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও এখন জনসংখ্যার ১১ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থান করছে। মানুষ শাক-সবজি, ফলমূল ও পশুজাত পণ্য থেকে পাওয়া ক্যালরির বড় একটি অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। তবে খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্যের সমন্বয় হচ্ছে না। ৬-২৩ মাস বয়সী তিনজন শিশুর মধ্যে মাত্র একজন দৈনিক আট শ্রেণীর মধ্যে পাঁচ শ্রেণীর খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। ইউএসএআইডির আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার এবং ৩১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় আইপিসি ওই পর্যবেক্ষণ চালায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্ট’ শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।

Source: Bonik Barta

Share the Post: