বাড়ছে দাবদাহ: খনিজের অসমতা-কিডনি জটিলতা ও হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে শিশুরা

চলতি মাসের শুরু থেকে দেশে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশুরা বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। দেশের হাসপাতালগুলোয় শিশু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। ডায়রিয়া ও কলেরার পাশাপাশি শিশুরা তাপপ্রবাহের কারণে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কিডনি জটিলতা, খনিজের অসমতা, স্নায়বিক সমস্যা ও হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ঝুঁকিতে রয়েছে।

দেশের দুটি শিশু হাসপাতালসহ পাঁচটি বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শিশু রোগীর হার বেড়েছে। শিশু রোগীর সিংহভাগই তাপপ্রবাহের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চলতি মাসের শেষে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যধিক গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে বয়স্ক ও শিশুরা। শিশুদের মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে রোদের মধ্যে খেলাধুলা করা, দীর্ঘ সময় কাটানো, পুকুর বা খালে বেশি সময় ধরে গোসল করাসহ নানা কারণে শিশুদের অসুস্থতা বাড়ছে। শিশুদেহ রোগ প্রতিরোধে সক্ষমতা কম থাকায় তারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গরমে শিশুদের দেহে খনিজের অসমতা (ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স) দেখা দিতে পারে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কলেরা, কিডনি জটিলতা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, স্নায়বিক সমস্যা, হিট স্ট্রোক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ৬৮১ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে তাপপ্রবাহের কারণে রোগী বাড়ছে। গত বছরের চেয়ে চলতি বছর রোগী ভর্তির হার বেশি। বছরের শুরু থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৭১০ জন নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে। আর গত বছরের পুরো সময় এ ধরনের রোগী ছিল সাড়ে তিন হাজার।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মহাখালী হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে বলে জানা যায়। ৩০০ শয্যার এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বুধবার রাত ১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী ২২৫ জন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়। আগের দিন ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয় ৪৭৪ জন। গত ২৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫৫০ জন রোগী ভর্তি হয়। এসব রোগীর মধ্যে শিশুর হার বেশি।

মূলত দূষিত পানি পানের ফলে ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গরমের কারণে ঘরের বাইরে ফুটপাত থেকে শরবত কিনে খাওয়া ও বাইরের খাবারে ব্যবহৃত পানি বিশুদ্ধ না হওয়ায় ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে। এছাড়া বাসি-পচা খাবারও ডায়রিয়ার কারণ। ঘেমে গিয়ে শিশুর ঠাণ্ডা লাগতে পারে। এতে তারা নিউমোনিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে।

আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালগুলোর প্রধান ডা. বাহারুল আলমের মতে, গরমের কারণে শিশু রোগীর বৃদ্ধি সাধারণত মে থেকে জুনের শেষ সময় পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। তবে এপ্রিলে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে শিশু রোগী বাড়ছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী দ্য ন্যাচারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, প্রচণ্ড গরমের সংস্পর্শে আসা শিশুরা শ্বাসতন্ত্রের রোগ, কিডনি রোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকে। শিশুরা যত বেশি তীব্র তাপের সংস্পর্শে আসে তারা তত বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, কিডনি রোগ, ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর এবং ইলেকট্রোলাইট অসমতার ঝুঁকিতে থাকে; যা হৃৎপিণ্ড এবং স্নায়বিকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে। এটি গুরুতর পানিশূন্যতা, ক্লান্তি ও হিট স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। এসব জটিলতার চিকিৎসা না হলে দ্রুত মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, কিডনি এবং পেশিগুলোর ক্ষতি করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরো মারাত্মক হতে পারে।

কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরবৃত্তিক কাজের জন্য প্রয়োজন কিছু রাসায়নিক পদার্থ, খনিজ ও লবণ। স্নায়ু ও মাংসপেশির কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব উপাদানকে বলা হয় ইলেকট্রোলাইট। সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম হলো প্রধান ইলেককট্রোলাইট। যেকোনো কারণে শরীরে এসব উপাদানের পরিমাণ কমে বা বেড়ে গেলে সৃষ্টি হয় ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা বা খনিজের অসমতা। এ খনিজের অসমতার কারণে দেখা দিতে পারে কিডনির জটিলতা। খাবার স্যালাইন বেশি খাওয়া হলেও এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

মাসের শেষে রোগী বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন চাঁদপুরের মতলব স্বাস্থ্য ও গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বির প্রধান ডা. মো. আল ফজল খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের মতলবের হাসপাতালটিতে সাধারণত চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরের ৩৫ উপজেলা থেকে রোগী আসে। ঈদের লম্বা ছুটি রয়েছে। আশঙ্কা করছি, চলতি মাসের শেষের দিকে ভর্তি অনেক বাড়তে পারে।’

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শিশু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তাপমাত্রা যত বাড়বে রোগীর সংখ্যাও তত বাড়ার শঙ্কা। গরমে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বেশি খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর ফলে খনিজের অসমতা তৈরি হয়। গরমের কারণে শিশুদের হিট র‌্যাশ হতে পারে। গরম বা তাপের কারণে ত্বকে যে ছোট ছোট লালচে দানা দেখা দেয় এবং চুলকানি ও জ্বালাভাবের সৃষ্টি হয় তাকে হিট র‌্যাশ বলে। গরমের কারণে বহু ধরনের জটিলতা হয়। এরপর হিট স্ট্রোকও হতে পারে। ফলে শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যেসব শিশু রোদে খেলাধুলা করে বা বাইরে থাকে তাদের এসব সমস্যা দেখা দেয়। নিউমোনিয়াও হতে পারে।’

জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ‘দ্য কোল্ডেস্ট ইয়ার অব দ্য রেস্ট অব দেয়ার লাইভস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলছে, ২০৫০ সালে বিশ্বে ২২০ কোটি শিশুর (১৮ বছরের কম বয়সী) প্রায় প্রত্যেকেই উচ্চ তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসবে, যা ২০২০ সালের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। বর্তমানে প্রায় ৫৬ কোটি শিশু উচ্চ তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে এসেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মানিক কুমার তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দূষিত পানির ব্যবহারের ফলে শিশুরা অসুস্থ হয় বেশি। এছাড়া আমাদের শহরগুলো বিশেষ করে ঢাকা শহরের দূষিত পরিবেশে শিশুরা নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। এ ধরনের আবহাওয়ায় শিশুদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে রাখতে হবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: