পুত্রবধূর গর্ভকালীন জটিলতার চিকিৎসা নিতে নরসিংদী থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এসেছেন হাজি আব্দুল আলী। তিনি জানতেন হাসপাতালটি সরকারি। কিন্তু সেখানে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। সকালে কনসালটেশন ফি দিয়েছেন ৬০০ টাকা। সরকারি হাসপাতালেও কেন এত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে তার মধ্যে। প্রশ্ন রাখেন, হাসপাতালটি সরকারি নাকি বেসরকারি। একই ধরনের সংশয়ে পড়েছেন যশোরের খালিদ। মায়ের স্নায়বিক সমস্যার উন্নত চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে এসে তিনি জানতে পেরেছেন, সকালে অধ্যাপকের কনসালটেশন ফি ৬০০, বিকালে ১ হাজার টাকা। এ অর্থ খালিদের মতো অনেকের জন্যই অপ্রত্যাশিত।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের চেয়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের বহির্বিভাগের ফি ২০ গুণ বেশি। হাসপাতালটি নিয়ে রোগীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতাল হলেও তাতে রয়েছে সরকারি অর্থায়ন ও ঋণ। ফলে সেবার মূল্য বেসরকারি হাসপাতালের মতো হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর তিন মাসের বেশি সময় পর আংশিক পরিসরে বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালু করা হয়। তবে শুরু হয়নি রোগী ভর্তি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু মেডিকেল যন্ত্রপাতি স্থাপন বাকি। এখন কনসালটেশন, বৈকালিক কনসালটেশন ও কিছু রোগ নিরীক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রায় চার একর জমিতে ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালটিতে প্রকল্প সাহায্য ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। সরকারের বরাদ্দ ৩৩৮ কোটি ও বিএসএমএমইউর নিজস্ব অর্থায়ন ১৭০ কোটি টাকা। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা ও বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পরামর্শ পাচ্ছেন রোগীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অধ্যাপকের কনসালটেশন ফি ৬০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৪০০ ও সহকারী অধ্যাপকের ৩০০ টাকা। আর বৈকালিক কনসালটেশনের জন্য অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের ফি যথাক্রমে ১ হাজার, ৮০০ ও ৬০০ টাকা।
যদিও এ ফি নির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। গত ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির সভায় ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সুপারিশ করা হয়েছে তা মানেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে বৈকালিক কনসালটেশনে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের ফি যথাক্রমে ৬০০, ৪০০ ও ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ অর্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পাবে ১০০ টাকা। আর রোগ নির্ণয়ের ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসএমএমইউ হাসপাতালের বর্তমান হারের চেয়ে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ কমিটির দুই সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থ কমিটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সকাল ও বিকাল দুই সময়ের জন্য কনসালটেশন ফি ৬০০, ৪০০ ও ৩০০ টাকা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। হাসপাতালটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে ওই ফিও বেশি হয়ে যায়। কিন্তু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল হওয়ায় কিছুটা বেশি ফি ধরতে হয়েছে। তবে সকাল বা বিকাল দুই বেলায়ই একই ফি নির্ধারণ করার কথা ছিল। সেক্ষেত্রে সকালে যেসব চিকিৎসক কনসালটেশন দেবেন সেখানের ফি থেকে তারা কোনো অংশ পাবেন না। বিকালের ক্ষেত্রে ফির ৬০ শতাংশ তারা পাবেন।’
কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ মনে করে, ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল মানেই হলো বড়লোকের হাসপাতাল। আমি বলেছি, সরকারের প্রতিষ্ঠান সবার জন্য সমান। কেননা সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। নাগরিকের সুবিধার জন্য সরকার অর্থ ব্যয় করে। আমি বারবার বলেছি, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রোগ নির্ণয় ও বৈকালিক কনসালটেশনের ফি ও সুপার হাসপাতালের ফি যেন এক হয়। সরকারের অর্থ বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে বার্ষিক থোক বরাদ্দের সঙ্গে নিজস্ব আয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলে। মূলত সেবার পরিসর বাড়ানোর জন্য সুপার হাসপাতালের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা চিকিৎসকদের আয় বৃদ্ধির জন্য নয়। তারা হয়তো বেশি মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। তবে সরকারের যেহেতু অর্থায়ন রয়েছে, ফলে তারা ইচ্ছা করলে এমন ফি রাখতে পারে না।’
জানা গেছে, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে বহির্বিভাগের টিকিটের মূল্য ৩০ ও বৈকালিক কনসালটেশন ফি ২০০ টাকা। তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ফি বিএসএমএমইউর চেয়ে সকালে ২০ গুণ ও বিকালে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেশি। দুটি হাসপাতালের ফির মধ্যে বিপুল পার্থক্য থাকলেও নবনির্মিত হাসপাতালটিকে ‘দেশের সর্বপ্রথম পাবলিক সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ হিসেবে পরিচয় দেয়া হচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, সরকারি হাসপাতালে কর্মঘণ্টার বাইরে প্রাইভেট চেম্বার (ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস) করে রোগী দেখতে পারবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। এ নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. সাইদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়ে নীতিমালা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বলার মতো সময় আসেনি। তবে বিএসএমএমইউ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের নীতিমালার সঙ্গে মিলবে না।’
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সেবার মূল্য সাধারণ মানুষের সক্ষমতার বাইরে কিনা এমন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিএসএমএমইউ হাসপাতালে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ৩০ টাকায় করি। আর সেখানে বৈকালিক কনসালটেশন ফি নেয়া হয় ২০০ টাকা। এর বাইরে যেকোনো সময় চিকিৎসা নেয়ার জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত কেউ যদি সেবা কিনতে চায় তা পায় না। আর বিকালেও বাইরে সেবা নিতে দীর্ঘ সময় লাইন ধরতে হয়। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে সহজেই বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ সুবিধা পাওয়া যায়। একটু সুবিধা দেয়ার জন্যই এ ব্যবস্থা। ধরুন বিএসএমএমইউ হাসপাতালে কেবিনের ভাড়া ২ হাজার, সুপার হাসপাতালে কেবিনের ভাড়া ৪ হাজার যদি না করি তাহলে ২ হাজারের রোগী ওখানে গিয়ে ভর্তি হলে ৪ হাজারের রোগীগুলো ওখানে যাবে না। আমরা সবাইকেই চিকিৎসা দিতে চাই। সচ্ছল-অসচ্ছল, ধনী-গরিব সবার জন্য চিকিৎসা অবারিত করতে চাই।’
অর্থ কমিটির সুপারিশ ভিন্ন থাকার পরও বৈকালিক কনসালটেশন ফি কীভাবে এত বেশি নির্ধারণ করা হলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অর্থ কমিটিতে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে।’
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মো. রসুল আমিন (শিপন) বলেন, ‘হাসপাতালের ফি সিন্ডিকেটে নির্ধারণ হয়েছে। সকালের সময়টুকু চিকিৎসকদের নিয়মিত কর্মঘণ্টার আওতায় থাকায় সে সময়ের ফি কিছুটা কম। আর বিকালে যেহেতু কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ করতে হয় সেজন্য পার্সেন্টেজ হিসাব করে এ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা যারা হাসপাতালের পরিচালনা কমিটিতে রয়েছি তারা শুধু নির্দেশনা প্রতিপালন করছি।’
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন-সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা সরকারি হাসপাতাল নয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার কিছু টাকা দেয়। লেখাপড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন টাকা দেয়। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই। যদি সরকার তহবিল না দেয় তাহলে এখানে বিনা পয়সায় বিশেষায়িত সেবা দেয়া সম্ভব না। যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়ে মতবিরোধ থাকবে। তবে সুপার স্পেশালাইজড হোক আর যা-ই হোক ফি মানুষের সক্ষমতার মধ্যে হতে হবে, সেটা হচ্ছে না।’
এ জনস্বাস্থ্যবিদের মতে, বিশেষায়িত এ হাসপাতালে দরিদ্র রোগীর জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা তা দেখতে হবে। ফি যৌক্তিক পর্যায়ে নেয়ার জন্য নানা কিছুই বলা যেতে পারে। তবে যার অর্থ নেই সে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসা পাবে কিনা সে প্রশ্নও রাখতে হবে বলে মনে করেন এ চিকিৎসক।
চিকিৎসা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে সেখানে স্বাস্থ্য বীমা অনেক খরচ বহন করে। বাংলাদেশে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় কম মূল্যে বিশেষায়িত সেবা দেয়া কঠিন। তবে চিকিৎসা নেয়ার অধিকার সবার আছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে।’
নির্ধারিত ফি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাসপাতালের সেবার মানের পার্থক্য থাকা উচিত নয়। সব ক্ষেত্রে সেবার মান একই রকম থাকতে হবে। তবে সুপার হাসপাতালে জরুরি সেবা ছাড়া বিশেষায়িত বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের জন্য যৌক্তির হারে কিছু বেশি মূল্য নেয়া যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, ৭৫০ শয্যার বিশেষায়িত এ সুপার হাসপাতালে থাকছে ১৪টি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি, ২২টি ভিআইপি ও ২৫টি ডিলাক্স কেবিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মধ্যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, জিন থেরাপি ও রোবোটিক সার্জারির ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া অটিজম, মাতৃত্বকালীন যত্ন ও শিশুযত্ন, জরুরি চিকিৎসাসেবা, হেপাটোবিলিয়ারি ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, কার্ডিওলজি ও সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ, নেফ্রোলজি, শ্বাসযন্ত্র, সাধারণ অস্ত্রোপচার, চক্ষুবিদ্যা, দন্ত চিকিৎসা, চর্মরোগ বিদ্যাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। বিশেষায়িত এ হাসপাতালে ৩০০ চিকিৎসকসহ প্রায় দেড় হাজার স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করবেন। এর মধ্যে শতাধিক চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।