গত তিন দশকে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত। বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে একের পর এক হাসপাতাল। বর্তমানে খাতটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ক্রমেই বাড়তে বাড়তে বর্তমানে দেশের বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ও সেবার সম্মিলিত আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের পরিষেবা, আকার, অবকাঠামোসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে ২০১৯ সালে এক জরিপ চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ওই জরিপেই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের এ চিত্রটি উঠে এসেছে। জরিপে পাওয়া তথ্যগুলো সন্নিবেশ করে সম্প্রতি ‘বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান জরিপ ২০১৯’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও সেবাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ব্যক্তিমালিকানার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ১৬ হাজার ৯৭৯টি। এর মধ্যে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ১০ হাজার ২৯১টি, হাসপাতাল ৪ হাজার ৪৫২টি ও মেডিকেল ক্লিনিক ১ হাজার ৩৯৭টি। এছাড়া দেশে বর্তমানে ৮৩৯টি বেসরকারি ডেন্টাল ক্লিনিকও রয়েছে।
বেসরকারি চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র পেতে এসব প্রতিষ্ঠানের সবগুলোকেই জরিপের আওতায় এনেছে বিবিএস। সংস্থাটির জরিপে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশক থেকেই দেশে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। নব্বইয়ের দশকে সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল ৩৮৪টি। এর পরের দশকগুলোয় এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। ২০১৮ সালের জুন শেষে সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৫২।
প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতি বছর বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের পণ্য ও সেবার আকারও ক্রমেই বেড়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৭৩৭ কোটি ১৪ লাখ টাকায়। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৬ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধির পেছনে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধিকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা ও অপর্যাপ্ততার কারণেই মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে জানালেন ল্যাবএইড গ্রুপের এমডি ডা. এএম শামীম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ আমাদের প্রবাসীরা। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকে। তারা দেশে পরিবারের সদস্যদের জন্য টাকা পাঠায়। পরিবারের সদস্যদের ছোটবড় যেকোনো সমস্যা হলে তারা ব্যক্তি খাতেই চিকিৎসা নিতে ব্যয় করে। মানুষ এখন এক বেলা কম খেলেও চিকিৎসকের কাছে যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি হাসপাতালে কেবিন পাওয়া ছিল আনন্দের বিষয়। কিন্তু এখন যারাই কিছুটা সক্ষম, তারা কিন্তু সরকারি হাসপাতালে কেউ যায় না। আবার সরকারি হাসপাতালে সেবা ফ্রি বলা হলেও সেখানে বেড পেতে লাগে ১৫ দিন। এখন কেউ একটা গলব্লাডারের ছোট অপারেশন করতে গেলেও সেবা পেতে সময় লেগে যায় ২৭-২৮ দিন।
সব বেসরকারি হাসপাতালেরই চিকিৎসার মান ভালো নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করতে হবে। আমাদের ১০-২০টি হাসপাতাল ভালো, কিন্তু সব হাসপাতাল ভালো না। এ জায়গাটিতে কাজ করতে হবে। ভারতে এখন পৃথক কর্তৃপক্ষ হয়েছে, যাদের অ্যাক্রেডিটেশন নিয়ে কাজ করতে হয়। ওই কর্তৃপক্ষের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণ হয়। সব পক্ষ একসঙ্গে কাজ করে। এগুলো আমাদের এখানেও করতে হবে।
চলমান কভিড পরিস্থিতিতে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বারবার। জরিপেও দেখা গিয়েছে, দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে লাইফ সাপোর্ট সুবিধা দিতে পারছে মাত্র ১৫ শতাংশের কিছু বেশি। উন্নত লাইফ সাপোর্ট দিতে পারছে সোয়া ৪ শতাংশ।
একইভাবে প্রাথমিক জরুরি ট্রমা সেবা দিতে পারছে ৩০ শতাংশেরও কম হাসপাতাল। উন্নত ধরনের জরুরি ট্রমা সেবা দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি প্রতিষ্ঠানের। শল্য চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি ও ব্রেকিথেরাপি, কো-৬০, লিনাক, কেমোথেরাপি ইত্যাদি ক্যান্সার থেরাপি-সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত সেবা দিতে সক্ষম মোট বেসরকারি হাসপাতালের ৫ শতাংশ।
চিকিৎসাসেবা ছাড়াও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিষ্ঠানই বেশ পিছিয়ে। এখনো ২৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নেই। এছাড়া ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকারী যন্ত্র রয়েছে যথাক্রমে প্রায় ১৮ ও ৯ শতাংশ হাসপাতালে। স্বয়ংক্রিয় অগ্নি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা পাওয়া গিয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ হাসপাতালে। এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই প্রায় ২১ শতাংশ হাসপাতালের।
বিবিএসের জরিপে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থার চিত্রও উঠে এসেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, মাত্র ৪৬ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল কঠিন চিকিৎসা বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে। পরিবেশের কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা না করে খোলা জায়গায় কঠিন চিকিৎসা বর্জ্য ফেলে প্রায় ৩৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে কোনো ধরনের পরিশোধন না করেই তরল বর্জ্য নর্দমা/নালায় ফেলছে প্রায় ৪৩ শতাংশ হাসপাতাল। সাড়ে ৬ শতাংশ হাসপাতাল তাদের তরল বর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন না করেই নদীতে বা খালে ফেলছে।
বেসরকারি খাতের অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে ইউনাইটেড গ্রুপের তত্ত্বাবধানে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন হাসান রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পলিসি গাইডলাইন নেই। এ ধরনের খাতগুলোয় প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ মডেল সবচেয়ে ভালো। এ মডেলটা এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা খাতে সক্রিয় রেগুলেটরি বডি বা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিযোগ আছে প্রাইভেট খাতে বেশি বিল চার্জ করা হয় বা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এ ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন। যদি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো, আস্থা সৃষ্টিতে যদি সরকারি কিছু পদক্ষেপ থাকত আমি মনে করি আমাদের স্বাস্থ্য খাত অনেক এগিয়ে যেত।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্লিনিকের শুধু সেবা বিক্রির আয় ১ হাজার ১১১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। ক্লিনিকের মধ্যে একমালিকানা ও অংশীদারিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। ডেন্টাল ক্লিনিকের মধ্যে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে তা ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন ও ৪০ শতাংশ অংশীদারিত্বে রয়েছে। অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এর সেবা বিক্রয়কৃত অর্জিত রাজস্ব ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ হাজার ১৪৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক মাত্রায় ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালে প্রতি এক হাজার মানুষের বিপরীতে শয্যার চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা দ্বিগুণ। যদিও বেসরকারির সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নিলে প্রতি এক হাজার জনগণের বিপরীতে শয্যা সংখ্যা দশমিক ৯৬। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী তা হওয়ার কথা ৩ দশমিক ৫টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবাবঞ্চিত হয়েই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যায়। খরচ বেশি হলেও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হয়রানি বন্ধ না হলে মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দোকানঘরের মতো গড়ে উঠেছে। এতে মান বজায় থাকছে না। শুধু বাণিজ্য বাড়ছে।
স্বাস্থ্যসেবার প্রতি সরকারের মনোযোগ নেই উল্লেখ করে এ স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরকারিভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে। বার্ষিক বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও এর প্রতিফল দেখা গেছে। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি ৮-৯ নম্বরে রাখা হয়, যা সাধারণ ২-৩ নম্বরের দিকে থাকার কথা।
বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত দেশের চিকিৎসাসেবায় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি এমএ মবিন খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের বেশ কয়েকটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রেখে চলেছে, সেটি স্বীকার করতেই হবে।