দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এরই মধ্যে এডিস মশাবাহিত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে ৬২ জেলায়। ভেঙেছে এক বছরে এ যাবত্কালের মৃত্যুর রেকর্ডও। আক্রান্তরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে ছুটছেন হাসপাতালে। তবে জটিলতা অনুযায়ী চিকিৎসা মিলছে না জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয়। মূলত সেখানকার চিকিৎসকদের এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেই এমনটি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জরুরি চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা। ফলে রোগীর অবস্থা কিছুটা জটিল হলেই পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষায়িত কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সাড়ে ৪৬ হাজার ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে প্রায় ৩১ হাজার এবং ঢাকার বাইরে ১৬ হাজার রোগী বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিল। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছিল সরকার। সে বছরের মৃত্যুর সংখ্যাও (১৭৯ জন) এতদিন ছিল সর্বোচ্চ। ওই রেকর্ড ভেঙে চলতি বছর গতকাল পর্যন্ত ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজধানীতে মারা গিয়েছে ১১৬ জন আর বাইরে ৭৭ জন। যদিও সরকারের দেয়া কোনো তথ্যেই জেলা পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতাল ও বাড়িতে থাকার রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয় না।
দুই বছর আগের অর্থাৎ ২০১৯ সালের চেয়েও এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ববিদরা। তাদের দাবি, এ বছর নতুন নতুন জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে সেখানকার চিকিৎসকরা রোগটি চিকিৎসায় অনভিজ্ঞ। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি, মূলত ওইসব এলাকায় রোগটির যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না।
নড়াইল জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ ডেঙ্গু রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও বাড়িতে বসেও অনেকে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে ডেঙ্গু রোগীদের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ, সেবা দিতে প্রয়োজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। একই সঙ্গে দরকার আধুনিক জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাপনা। তাই ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে ডেঙ্গু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় খুলনা কিংবা যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কোনো কোনো রোগীকে ঢাকায়ও পাঠানো হয়। সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সুজল কুমার বকসী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন সংকটের বিষয় বিবেচনা করে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কেননা অনেক সময় এসব রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে সে সুবিধা নেই। বহু আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাও নেই এখানে। চিকিৎসকস্বল্পতাও রয়েছে।
চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনা অঞ্চলের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একটি জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের বেশ সংকট। ফলে রোগীদের বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই চিকিৎসার জন্য আসতে হচ্ছে। তাদেরই একজন পঁচিশোর্ধ্ব আব্দুল্লাহ আল মামুন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ যুবক গত শুক্রবার ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে। নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। তার অবশ্য মাথা ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে যাওয়া, মল কালো হয়ে তাতে রক্ত যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই সে রোগীদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোগীরাও ওইসব হাসপাতালে থাকতে চাচ্ছে না। আবার জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরাও কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।
কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে আসছে। এ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসা পাওয়া যায় বলেই এমনটি হতে পারে। আবার জেলাগুলোর হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সুবিধারও কিছুটা সংকট রয়েছে। যেসব ডেঙ্গু রোগীর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তারাই মূলত বিশেষায়িত সেবার জন্য আসছেন।
ঢাকার একটি সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকে আসা রোগীদের যে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে তা পরিমাণে অতিরিক্ত। মাত্রা ও সময়ে ব্যাপ্তির সমন্বয় স্যালাইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয়নি। একই সঙ্গে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট লাগলে তাকে প্লাটিলেটই দিতে হবে। রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে দিতে হয়। জেলা পর্যায়ে এসব সুবিধার অভাব রয়েছে। আবার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দিচ্ছেন। ফলে রোগীর শরীরে আরো জটিলতা দেখা দিয়েছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিরায় যে স্যালাইন দেয়া হয় সেটাই হলো আইভি ফ্লুইড। এটি দেয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপ ও বিধি রয়েছে। অতিরিক্ত স্যালাইন দেয়া হলে সেটা হূদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুসসহ দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে পারে। এতে রোগীর অবস্থা হয় সংকটাপন্ন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। এতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে প্লাটিলেট কমে গেলেও তা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আপনাআপনিই ঠিক হয়ে যায়। অথচ উপজেলা ও জেলার চিকিৎসকরা এসব রোগীর দেহে রক্ত পুশ করছেন, যা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, জরুরি বা যেকোনো রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। জেলা হাসপাতাল থেকে আবার পাঠানো হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে উপজেলা হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগের সেবা পরিপূর্ণভাবে চলছে না। একই সঙ্গে জরুরি সেবাও সন্তোষজনক নয়। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে পদক্রমের চিকিৎসক প্রয়োজন সেসবও এখানে নেই। আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার যারাই থাকেন তারা নবীন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতাও কম। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রয়োজন হয় বিভিন্ন চিকিৎসা সুবিধাও। তবে এসবের ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঘাটতি চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে দুপুরের পর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা হয় না। নেই প্যাথলজিস্টও। অনেক ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলায় রোগীর রক্তচাপ, নাড়ি পরীক্ষার বাইরে জরুরি চিকিৎসায় যেন আর কিছুই করার থাকে না।
সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নিয়মিতভাবেই চিকিৎসকদের দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। সারা দেশে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে সরকার। সে অনুযায়ীই চিকিৎসা দিচ্ছে সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু ডেঙ্গুর জন্যই জেলা পর্যায়ের মানুষজন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছে, এমনটি সঠিক নয়। যেকোনো রোগের জন্যই তারা ঢাকায় আসছে। হাতের কাছে সঠিক চিকিৎসা থাকার পরও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মানুষ ঢাকায় এসে ভিড় করে।