দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করার কারণে দেহের হাড় ও মাংসপেশিতে দেখা দেয় নানা জটিলতা। বিশেষ করে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। কাজের ধরন ও কর্মক্ষেত্রের আসবাবের ভুল নকশা এসবের জন্য মুখ্য প্রভাবক। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগারের টেবিল-বেঞ্চ তৈরি না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হাড় ও মাংসপেশির জটিলতা বা মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।
অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত পেশাগত কাজও মানবদেহে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, শরীরের যেকোনো হাড়, পেশি, টেন্ডন, লিগামেন্ট ও নরম টিস্যুতে ব্যথা সৃষ্টি হলে তাকে মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার বলে। এ গুচ্ছরোগ শরীরে আরো বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়; কর্মদক্ষতা ও মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা হলো পিঠ ও ঘাড়ের ব্যথা, আর্থ্রাইটিস, রিউম্যাটয়েড ও ফ্র্যাকচার। এসব রোগ দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর ব্যথা, শারীরিক অক্ষমতা, এমনকি প্রাথমিক মৃত্যুরও কারণ। বিশ্বে কয়েক কোটি লোক এ জটিলতায় ভুগছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগারের আসবাবপত্র ব্যবহারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাস্কুলোস্কেলিটাল সমস্যায় ভোগার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা, তা জানতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ৪০০ শিক্ষার্থীর ওপর একটি জরিপ চালায় একদল গবেষক। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি গবেষকরা তাদের শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগারের আসবাবেরও বিভিন্ন পরিমাপ নেন। এ গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় ‘অ্যাসেসমেন্ট অব মাস্কুলোস্কেলিটাল প্রবলেমস অ্যামং বাংলাদেশী ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন রিলেশন টু ক্লাসরুম অ্যান্ড লাইব্রেরি ফার্নিচার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন, যা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল স্প্রিঙ্গারে প্রকাশিত হয়েছে। দ্য ইনস্টিটিউশনস অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (ইন্ডিয়া) সহায়তায় গবেষণাটি চালানো হয়েছিল।
গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগারের আসবাব শরীরের জন্য আরামদায়ক ও বিজ্ঞানসম্মত না। তাই ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীই হাড় ও মাংসপেশির ব্যথা বা মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ জটিলতার হার বেশি। মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় অবস্থান এবং ত্রুটিপূর্ণ আসবাব ব্যবহারের কারণেই এ হারটা বেশি বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিঠের নিচে ব্যথা, যা প্রায় ৫২ শতাংশ। ছাত্রদের মধ্যে এ হার ৩৮ শতাংশ থাকলেও ছাত্রীদের মধ্যে এর প্রবণতা ৭৬ শতাংশ। পশ্চােদশ বা কোমরের নিচে ব্যথায় ভুগছেন ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর কাঁধের ব্যথা রয়েছে ৩০ শতাংশ, ঘাড়ে ৩৭ শতাংশ ও হাঁটুতে ২৪ শতাংশের। এছাড়া পায়ের পাতা, কোমরের উপরিভাগ, কবজি, কনুই, বাহুর ওপরের অংশ, বাহু, আঙুল ও পায়ের নিম্নাংশে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যথা থাকার কথা জানিয়েছেন।
গবেষক দলের সদস্য কুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক সোহেল পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, গবেষণায় কেবল স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যেহেতু তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসবাবপত্রগুলো ব্যবহার করছেন, তাই তাদের ওপর এর প্রভাবের বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হয়। গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ভুল নকশায় বানানো আসবাবপত্র ব্যবহারের কারণে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী মাস্কুলোস্কেলিটাল সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সময়ের এক-তৃতীয়াংশই ব্যয় করে শ্রেণীকক্ষে ও গ্রন্থাগারে। এতে বৈজ্ঞানিকভাবে শরীরের জন্য অনুপযোগী আসবাবে দীর্ঘক্ষণ অনুপযোগী ভঙ্গিতে বসায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার কারণ খুঁজতে আমরা আরেকটি গবেষণা করি। সেখানে দেখানো হয়েছে, আদর্শ মানদণ্ডে কীভাবে আসবাবপত্র তৈরি করলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার বা জটিলতা মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার প্রধান কারণ এবং এতে জীবনের গুণগত মান কমে যায়। শারীরিক এ সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়া না হলে তাদের জন্য সমস্যা আরো গুরুতর হয়। তবে এসব রোগ সরাসরি মৃত্যুর কারণ না হলেও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসা খরচের সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতাকে প্রভাবিত করে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হায়াতুন নবী দীর্ঘদিন মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, বিভিন্ন পেশা ও পরিস্থিতির কারণে হাড় ও মাংসপেশিতে ব্যথা হতে পারে। কোনো কর্মক্ষেত্রে কাজের জন্য যে ব্যবস্থাপনা থাকে যেমন বসার স্থান, টেবিলের মাপ, কম্পিউটার মনিটরের দূরত্ব থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয় বিজ্ঞানসম্মত হওয়াকে আর্গোনমিক বলা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পরিশ্রম ও অস্বাভাবিকভাবে শারীরিক কসরত এ রোগগুলোর সঙ্গে জড়িত। তিনি আরো বলেন, দেশে দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক অনেক রোগের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলেও এ ডিজঅর্ডারের বিষয়ে তেমন সচেতনতা নেই। আমরা বিষয়টিকে অবহেলা করছি। মানুষের কর্মক্ষেত্র, জীবনাচারের সঙ্গে এ রোগগুলো জড়িত। সচেতন ও ব্যবস্থাপনা সঠিক হলে এসব এড়িয়ে থাকা যায়।
সারা বিশ্বে ১৭১ কোটি মানুষের হাড় ও মাংসপেশির ব্যথা রয়েছে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার বিশ্বে মানুষের অক্ষমতার জন্য প্রধানত দায়ী। অন্তত ১৬০টি দেশের মানুষের শারীরিক অক্ষমতার মূল কারণ নিম্ন পিঠের ব্যথা। এ জটিলতা মানুষের গতিশীলতা ও দক্ষতাকে সীমিত করে। এসব ব্যক্তি খুব দ্রুত অবসরে যান। একই সঙ্গে সমাজে তাদের অংশগ্রহণ কমে যায়। যদিও বার্ধক্যজনিত কারণে মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। পেশি ও হাড়ের এমন ব্যথা ক্রমবর্ধমান।
বাত ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরের হাড় ও মাংসপেশিতে ব্যথা সৃষ্টি হলে কর্মক্ষমতা কমে যায়। একই সঙ্গে আরো অনেক জটিল রোগের জন্ম দেয়। এসব শারীরিক অবস্থা হূদরোগ, ক্যান্সার, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ প্রধান প্রধান অসংক্রামক রোগের সঙ্গে যুক্ত। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হরমোনের সমস্যা, মানসিক সমস্যাও এসব রোগের কারণে হতে পারে। পরিবেশের বিপর্যয় ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে।
সঠিক পদ্ধতি ও পরিমিত কাজ না করা হলে মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম সালেক বণিক বার্তাকে বলেন, শরীরের ভেতরের অন্ত্র বাদ দিয়ে হাড় বা মাংসপেশি, টেন্ডন, লিগামেন্ট, নরম টিস্যুতে ব্যথা হওয়াকে মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডার বা ডিজিজেস বলা হয়। বেশি কাজ করলে বা অলসতার জন্য এসব জটিলতার সৃষ্টি হয়। বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুঁকে কাজ করা, ত্রুটিপূর্ণ চেয়ার-টেবিলে বসে পড়াশোনা করা, গেম খেলা, শুয়ে দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন দেখার ফলেও এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ শারীরিক সমস্যা এসব জটিলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।