বিষক্রিয়ায় হাসপাতালে শিশু রোগী: কোমল পানীয়র বোতলে রাসায়নিক সংরক্ষণের কারণে ঘটছে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা

বিষপানে হাসপাতালগুলোয় ভর্তি শিশু রোগীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশুরা যে বিষ বা রাসায়নিক পান করে তা রাখা হয় কোমল পানীয়র বোতলে। মূলত অভিভাবকের সচেতনতার অভাব, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, বিষ ও রাসায়নিক বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের অবহেলা এবং কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের উন্নাসিকতার ফলে এসব ঘটছে বলে মনে করছে জনস্বাস্থ্যবিদরা।

যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিক সাময়িকী বিএমজে এবং রয়েল কলেজ অব পেডিয়াট্রিকস অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের বিজ্ঞান সাময়িকী বিএমজে পেডিয়াট্রিকস ওপেন জার্নালে ওই গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ পায়। ‘অ্যাকসিডেন্টাল পয়জনিং ইন চাইল্ড: আ সিঙ্গেল সেন্টার কেস সিরিজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটি করেছেন ছয়জন চিকিৎসক, শিক্ষক ও গবেষক।

ভোলার লালমোহন উপজেলার আড়াই বছরের শিশু রাইয়ান আহমেদ (ছদ্মনাম) সালফিউরিক অ্যাসিড পান করে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে ভর্তি। শিশুটির মা সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে জানান, শিশুটি সালফিউরিক অ্যাসিড পান করে তাদের গ্রামের বাড়িতে ২০ মে। এরপর তাকে জেলা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে এ হাসপাতালে।

রাইয়ানের মা বণিক বার্তাকে জানান, একই বয়সের দুটি ছেলে শিশু রয়েছে তার। অন্য শিশু অসুস্থ থাকায় তাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে রাইয়ান সালফিউরিক অ্যাসিড পান করে। শিশুটির বাবা স্বর্ণকার হওয়ায় ঘরে সালফিউরিক অ্যাসিড ছিল।

গবেষকরা জানান, বিশ্বব্যাপী শিশুদের অনিচ্ছাকৃত আঘাতের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো বিষ। শ্বাসের মাধ্যমে, ইনজেকশনের মাধ্যমে, খেয়ে ফেললে গুরুতর অসুস্থ বা মৃত্যু হতে পারে। একই সঙ্গে তীব্র বিষক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি নিউরোসাইকিয়াট্রিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ হতে পারে। কভিড-১৯ মহামারীর আগে ১১ মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে বিষপানের কারণে ভর্তি হওয়া প্রায় ২৫০ রোগীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণা এই প্রথম।

গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনাবশত বিষপানে হাসপাতালে আসা শিশুদের বেশির ভাগের বয়স দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। বিষপানের দুর্ঘটনা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ঘটেছে বাড়িতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শয়নকক্ষ ও রান্নাঘর। এসব ঘটনার ৭০ শতাংশ বাবা-মা বা অভিভাবকদের সামনে ঘটেছে।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের ৩৩ শতাংশ কেরোসিন পান করেছিল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ ছিল কীটনাশক গ্রহণ। ২৭ শতাংশ শিশু এ কারণে হাসপাতালে এসেছে। ১৮ শতাংশ খেয়ে ফেলেছিল ওষুধ। ১১ শতাংশ ব্লিচিং পাউডার, টয়লেট্রিজ, ফিনাইলের মতো ঘরোয়া রাসায়নিকের কারণে বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়েছে। আর ১২ শতাংশ অন্যান্য পদার্থ খেয়ে ফেলেছিল। ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ঘটেছে রাসায়নিক বা ওষুধের পদার্থগুলো শিশুর নাগালের মধ্যে রাখার কারণে। এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে রাসায়নিক (কেরোসিন) কোমল পানীয়র বোতলে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যা শতকরা ৩৩ শতাংশ। আর দুই-তৃতীয়াংশ (৬৯) পদার্থ আসল পাত্রে রাখা হয়নি।

গবেষকরা জানান, কোমল পানীয়র ফেলে দেয়া বোতলে গৃহস্থালিতে রাসায়নিক সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে কেরোসিন অন্যতম। আর এসব বোতলে সংরক্ষিত কেরোসিনে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত বিষক্রিয়ার এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী। দুর্ঘটনার ৬৫ শতাংশই ছোট পরিবারগুলোয় ঘটেছে।

গবেষণাটির মুখ্য গবেষক ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা অভিমান বা ইচ্ছা করে বিষ পান করে না। তারা জানেই না যে এটা বিষ। আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই এসব রাসায়নিক কোমল পানীয়র ফেলে দেয়া বোতলে রাখা হয়। এসব বোতলে ভরে বাজার থেকে কেরোসিন বা অন্যান্য রাসায়নিক, কীটনাশক বাড়িতে আনা হয়।’

তিনি জানান, যারা কোমল পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তারা অসচেতনতার জন্য মোটা অংশে দায়ী। দুর্ঘটনা এড়াতে তারা সচেনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে। বোতলের গায়ে সতর্কতা উল্লেখ করতে পারে। একই সঙ্গে বোতলগুলো এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে তা যেন সহজে খোলা না যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, দুর্ঘটনাজনিত বিষক্রিয়ার কারণে সারা বিশ্বে বছরে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। এসব দেশে শিশুদের মৃত্যুর ১০ শতাংশই হচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত বিষপানে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অ্যাকসিডেন্টাল পয়জনিংয়ে শিশু রোগীরা আমাদের হাসপাতালে সারা বছরই আসে। বেশির ভাগ শিশু কেরোসিন খেয়ে ফেলে। কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিকও রয়েছে। এসব রাসায়নিক সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কোমল পানীয়র বোতলে রাখা হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এগুলো শিশুর হাতের নাগালের মধ্যে রাখা হয়। গ্রামের গৃহস্থরা দেখা যায় খাটের নিচে রাখে। কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি হয় যে রোগীকে বাঁচানো যায় না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ ফয়েজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে পয়জনিং বা বিষক্রিয়ার ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই দুর্ঘটনাবশত ঘটে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে খাদ্য বা অন্য কোনো কারণে হয়ে থাকতে পারে। দুর্ঘটনাবশত যেসব ঘটে তা অভিভাবকদের অসচেতনতার ফলে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: