বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান: বছরের ব্যবধানে নিবন্ধনের আবেদন দ্বিগুণ

করোনা মহামারীর মধ্যেই গত বছর হঠাৎ করে আলোচনায় আসে বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট হাসপাতাল। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল হিসেবে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হলেও ছিল না নিবন্ধন। পরে বিভিন্ন অনিয়ম সামনে এলে নিবন্ধনহীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার কারণ দেখিয়ে গত জুলাইয়ে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে সময় একের পর এক বেশকিছু হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করে অনিয়ম ও নিবন্ধন না থাকার প্রমাণ পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থায় নিবন্ধনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন নিতে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয় সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের মাথায় নতুন তিন হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে, যা আগের অর্থবছরের দ্বিগুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে অনলাইনে নিবন্ধিত ক্লিনিক বা হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৮ হাজার ২১১টি। নিবন্ধনের জন্য অপেক্ষমাণ প্রায় চার হাজার। এর বাইরে কয়েক হাজার অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার সঠিক হিসাব নেই। তবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম নয়। ঢাকা বিভাগের পর বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে বিভাগীয় শহরে। জনবহুল শহর ও শহরের উপকণ্ঠে দুই বছরে এসব প্রতিষ্ঠান বেড়েছে।

গত বছর দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনিয়ম সামনে এলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কোনোটি সিলগালা করে কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, আবার কোনোটিকে মোটা অংকের অর্থদণ্ড দেয়া হয়। নিবন্ধনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয় সরকার। ফলে বছরের ব্যবধানে আবেদনের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) নিবন্ধনের জন্য নতুন ৩ হাজার ২৪২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। গত ৩১ মে পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে বরিশাল বিভাগে ২২৪টি, চট্টগ্রামে ৫৫২টি, ঢাকায় ৯৯৬টি, খুলনায় ৩৮২টি, ময়মনসিংহে ২৪৫টি, রাজশাহীতে ৩৮৯টি, রংপুরে ২৯৫টি ও সিলেট বিভাগে ১৫৯টি নতুন প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এসব আবেদনের বিপরীতে মোট নিবন্ধন পেয়েছে ৪৫২টি প্রতিষ্ঠান। আবেদনের এ সংখ্যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে নবায়ন বাদে শুধু নতুন নিবন্ধনের জন্য আট বিভাগে আবেদন করেছিল ১ হাজার ৭২৫টি প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮২ সালের মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স আইনের অধীনে বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংককে নিবন্ধন দেয়া হয়। প্রতি বছর নবায়নও করা হয় এ আইনের আলোকে। কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে চারটি ধাপ শেষে নিবন্ধন দেয়া হয়। আবেদনগুলো ত্রুটিপূর্ণ কিনা তা দেখা হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করা হয়। নিবন্ধনের শর্তগুলো ঠিক আছে কিনা তা সিভিল সার্জনই নিশ্চিত করেন। তার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধনের সুপারিশ দেয়া হয়। গত বছর সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে অনিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদন করেছে বলে আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি করেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষের মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ বেড়েছে। কিছু টাকা হলেই মানুষ কোনো ব্যবসায় যেতে চায়। ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতাকে পুঁজি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠছে বলে মনে করছেন সরকারের সাবেক এ কর্মকর্তা।

তবে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্যের বাজার তেমন একটা বাড়েনি। অনেক হাসপাতাল তার খরচই তুলতে পারছে না। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এতদিন নিবন্ধন করেনি তারাই বেশি আবেদন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার ওপর ওই এলাকায় বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আধিক্য নির্ভর করে। বেসরকারি ক্লিনিকের আয় নির্ভর করে চার-পাঁচটি অপারেশনের ওপর। করোনার কারণে এসব প্রায় বন্ধ।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি, যেন কোনো প্রতিষ্ঠানই অনিবন্ধিত না থাকে। কেউ নিবন্ধন না নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধন করা যায়। দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত থাকলেও একদিনে তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। তবে শিগগিরই আবেদনকৃতদের শর্ত ঠিক থাকলে নিবন্ধন দেয়া হবে। নিবন্ধন ছাড়া কাউকেই প্রতিষ্ঠান চালাতে দেয়া হবে না।

Source: Bonik Barta

Share the Post: