কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন পর্যন্ত আন্দোলনে হতাহতদের পরিচয়সহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে গত ১৫ আগস্ট একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এ তালিকা ধরে আহতদের চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং নিহতদের পরিবারকে সহায়তা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সে তালিকা প্রস্তুত করতে পারেনি সরকার। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য দাবি করেন, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে ধীরগতির কারণে এ কাজে বিলম্ব হচ্ছে। পাশাপাশি নিহতদের অনেকেরই পূর্ণাঙ্গ তথ্য মিলছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
জানা যায়, দেশের হাসপাতালগুলোয় কত রোগী ভর্তি হয় এবং মারা যায় তার একটি প্রতিবেদন নিয়মিত পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। জুলাই ও আগস্টে হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে হতাহতদের তথ্যও নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। তবে বেসরকারি কোনো হাসপাতাল থেকেই এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য মিলেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন কমিটির তদারকিতে অধিদপ্তরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) হতাহতদের তথ্য নিচ্ছে। তবে এখনো বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। আর নিহতদের তালিকা করার ক্ষেত্রে যেসব মরদেহ হাসপাতালে আনা হয় এবং নথিভুক্ত করা তাদের তথ্য, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতদের তথ্য নেয়া হয়েছে। অনেক মৃতের আবার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। আন্দোলন চলাকালে অনেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। রাস্তা থেকেই তাদের সহযোদ্ধা বা পরিবারের সদস্যরা মরদেহ নিয়ে যায়। তাদের তথ্য নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা জানান, কোনো কোনো নিহতের শুধু নাম রয়েছে নথিতে। বিস্তারিত পরিচয় নেই। সহিংসতার ওই দিনগুলোয় অনেক মৃতের পূর্ণাঙ্গ তথ্য কেউ দেননি। এখন তাদের খোঁজা হচ্ছে। তাছাড়া যেসব মরদেহ ঘটনাস্থল থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা যে আন্দোলনে মারা গেছে তার প্রমাণপত্রও প্রয়োজন। যে কেউ এসে দাবি করলেই তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। হাসপাতালগুলো থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান তথ্য দিচ্ছে।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) তাদের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণবিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কমপক্ষে ৮১৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩০ জনের নাম জানা গেলেও ১৮৯ জনের পরিচয় জানতে পারেনি বলে জানায় সংগঠনটি। এছাড়া সারা দেশে আহত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। বিভিন্ন গণমাধ্যম, হাসপাতাল, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তারা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে জানায়।
রাজধানীর রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে গত ২৯ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এক হাজারের ওপরে লোক নিহত হয়েছে। আবার অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে ৪০০ জনের ওপরে।
জুলাইয়ের শুরুতে শুধু ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন হলেও ১৬ জুলাই থেকে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন সহিংসতায় নিহত হয় ছয়জন। দিনকে দিন বাড়তে থাকে সহিংসতা, বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যাও। সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে সরকার পতনের দিন। নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশই প্রাণ হারিয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে।
এদিকে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের পরিবারকে সহায়তার উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং তাদের পরিচিতিসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করে সরকার। ১৫ আগস্ট গঠিত ওই কমিটির তদারকিতেই তালিকা তৈরিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে কমিটি কাজ শুরু করার আগে ১২ আগস্ট পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেবল সরকারি হাসপাতালভিত্তিক যে তালিকা করে তাতে মোট ৪০৭ জন নিহতের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যু হয় (ব্রড ডেথ) ২৯০ জনের। সরকারি এ হিসাবের বাইরে সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও মরদেহ আসে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও অনেকে মারা যায়। তবে সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণকারী এ প্রতিষ্ঠান।
কমিটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হতাহতদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আহত কেউ যদি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তার তথ্যও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১৫ হাজারের কিছু বেশি আহতের নাম পাওয়া গেছে। আর নিহতদের নাম পাওয়া গেছে পৌনে ছয়শর মতো। তবে এ তালিকা তৈরির কার্যক্রম ঠিক কবে শেষ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যেসব ব্যক্তি আন্দোলনে মারা গেছে কিন্তু হাসপাতালে নথিভুক্ত হয়নি, তাদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা জেলা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্দোলনের সমন্বয়কদের সুপারিশ লাগবে।
এদিকে যেসব মরদেহ সরকারি হাসপাতালে এসেছিল তার সব নথিভুক্ত করা যায়নি বলে বণিক বার্তাকে জানায় রাজধানীর অন্তত পাঁচটি টারশিয়ার (বিশেষায়িত) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে আসা মরদেহের অর্ধেক মর্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। যারা মরদেহ নিয়ে এসেছিলেন তারা এতটাই বিক্ষুব্ধ ছিলেন যে ঠিকভাবে কথাও বলা যায়নি। মৃতের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। বিক্ষুব্ধরা মরদেহ নিয়ে যান। কোনোটার ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদ লেখা সম্ভব হয়েছিল আবার কোনোটি জরুরি বিভাগের দরজা থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি বিভাগে মৃত ঘোষণার পর মর্গে না গেলে তার নিবন্ধন হয় না। ফলে হিসাবও রাখা যায় না।’
আওয়ামী সরকারের পতনের পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু মানুষ আমাদের কাছে আসার পর পরই মারা যান। আবার কিছু ব্রড ডেথ হাসপাতালে আনা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিয়ে আসা বেশ কয়েকটি মরদেহ নিবন্ধন ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই বিক্ষুব্ধরা নিয়ে যান।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রয়োজন বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের একটি দাবিও ছিল। জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে একটি তালিকা জনসাধারণের সামনে প্রকাশ হোক এটা আমরা চাই। আমরাও এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করছি। এছাড়া ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেশব্যাপী চালানো গণহত্যায় যাদের হত্যা করা হয়েছে তার অনেক তথ্যই এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। আশা করছি সব কিছুই উন্মোচন হবে।’
হতাহতদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য সরকারের গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটির আহ্বায়ক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেকেই জিজ্ঞাসা করে তালিকা প্রস্তুত কবে হবে? আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এখানে অনেক কাজ রয়েছে। আমরা চাচ্ছি একটি নির্ভুল তালিকা করতে। আহত বা ভর্তি রোগীদের তালিকার জন্য তেমন জটিলতা হচ্ছে না। তবে যারা মারা গেছেন তাদের অনেকের নাম বাদে বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে যেসব মরদেহ এসেছিল এবং চিকিৎসাধীন মারা গেছেন তাদের তথ্যই আমাদের কাছে আসছে। বেসরকারি হাসপাতালও তথ্য দিচ্ছে, তবে তা খুবই কম।’
নিহতদের তালিকা করার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে জানিয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে তথ্য আসছে। এরপর যাচাই-বাছাই করব। যেসব মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়নি তাদের তথ্য যাচাইয়ে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করছি। এক্ষেত্রে সমন্বয়করা আমাদের সাহায্য করছেন।’