দেশে পরিবার পরিকল্পনা সেবার বাইরে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। মূলত উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মীদের মাধ্যমে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। তবে লোকবল সংকটের কারণে সম্প্রতি এ কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ছে সংস্থাটি। সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ের ছয় শ্রেণীর এক-তৃতীয়াংশ পদ খালি রয়েছে। এতে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রসূতি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। কয়েক বছর ধরেই এ পরিস্থিতি চলমান। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
সরকারিভাবে দেশে প্রসূতিসেবা, মাতৃ, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থানীয় সরকার বিভাগ কয়েকটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি রয়েছে। প্রসূতি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সারা দেশে কয়েকটি কর্মসূচি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তবে অনুমোদিত লোকবলের ৩১ শতাংশ পদ খালি থাকায় ব্যাহত হচ্ছে কার্যক্রম।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএফপিও) পদে সারা দেশে ৪৯১টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ২৬৮টি খালি রয়েছে। ৭৮১টি মেডিকেল অফিসার (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য) পদের বিপরীতে খালি আছে ৩৩১টি পদ। ইউনিয়ন পর্যায়ে ২ হাজার ৭৪২টি পদের বিপরীতে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও) পদ খালি রয়েছে ৮৪৬টি। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) পদে অনুমোদিত পদ রয়েছে ৫ হাজার ৮১৩টি। তবে এতে খালি রয়েছে ২ হাজার ৭টি পদ। মূলত প্রসূতিদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে এ পদের কর্মীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকের (এফপিআই) ৪ হাজার ৬২৮টি পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৬৫৪টি পদ। আর ইউনিয়নে ওয়ার্ড বা কমিউনিটিভিত্তিক পরিবার কল্যাণ সহকারীর (এফডব্লিউএ) ২৩ হাজার ৩৯৭টি পদের বিপরীতে ৭ হাজার ৫৮৭টি শূন্য রয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচির আওতায় যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে রয়েছে; জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচলিত পাঁচটি পদ্ধতির প্রচার, পদ্ধতি গ্রহণে সহায়তা ও এসব পদ্ধতি গ্রহণের ফলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তা সমাধানের ব্যবস্থা। এছাড়া প্রসূতি ও গর্ভের সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে প্রসূতি মায়ের প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি), সন্তান প্রসব সেবা এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি)। নবদম্পতিদের কাউন্সেলিংয়েরও কার্যক্রম পরিচালনা করে এ অধিদপ্তর।
চলমান চতুর্থ জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচিতে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও তিন বছর ধরে তা স্থিতিশীল রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ২০২১ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে ক্রমান্বয়ে ১৫-তে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নেয়া হয়েছিল। তবে এখন প্রতি এক হাজারে ২৮ জন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। প্রসবকালে বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে কোনো প্রসূতির মৃত্যু হলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়। আগে দেশে শিশু জন্ম দিতে গিয়ে প্রসূতির মৃত্যু হার ছিল প্রতি হাজারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের পর ২০২১ সালের মধ্যে তা ১ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ লক্ষ্য পূরণে অনেকটা এগোনো সম্ভব হলেও তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শিশু মৃত্যুর সঙ্গে চিকিৎসা, প্রসূতি সেবা ও সামাজিক সুরক্ষা জড়িত। শিক্ষাগত যোগ্যতা, মায়ের বয়স, পুষ্টি ও জীবনাচারের ঘাটতিও এতে প্রভাব ফেলে। দেশে এখনো কিশোরীদের (১৫ থেকে ১৯ বছর) গর্ভধারণ আশানুরূপভাবে কমানো যায়নি। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। দেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ কিশোরীদের গর্ভধারণ। কিশোরীদের গর্ভধারণের ফলে মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। আবার বাড়িতে সন্তান জন্ম দিলেও তা ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
বিবিএস বলছে, দেশে ৪৪ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হয়। আবার বাড়িতে সন্তান জন্মদানকারী মায়েদের ৭৩ শতাংশই কিশোরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়িতে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর হাতে প্রসূতির প্রসব হয়। ফলে মা ও সন্তানের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকবল সংকটের কারণে এ খাতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে লোকবল বাড়ানো না গেলে মা ও শিশু মৃত্যু হার কমানোর বিষয়ে উন্নতি হলেও লক্ষ্য অর্জনে আরো সময় লাগবে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মো. মাহমুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, লোকবলের সংকট সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের বিষয়ে উন্নতি রয়েছে। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন। প্রয়োজনীয় লোকবল পেলে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব শূন্যে আনতে পারতাম। ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার (এফডব্লিউভি) মাধ্যমে প্রসবকালীন সেবা দেয়া হয়। তাদের নিয়োগের পর ১৮ মাস প্রশিক্ষণ দিতে হয়। এরপর কাজে পাঠানো হয়। অর্থাৎ এ লোকবল নিয়োগ দিলেও কাজে পাঠাতে দুই বছর সময় লাগে। তাই আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলছি, এখানে নার্স নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে। তবে নার্স দ্বিতীয় শ্রেণীর হলেও এফডব্লিউভি তৃতীয় শ্রেণীর। সেক্ষেত্রেও পদগত জটিলতা রয়েছে। তবে আমরা সংকট নিরসনে কাজ করছি। কোনো কোনো উপজেলায় আমরা শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে সক্ষম হয়েছি। সেক্ষেত্রে অবশ্য স্থানীয় ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের সহায়তা পেয়েছি।
কর্মকর্তারা জানান, প্রসবের সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি কমতে থাকে। রক্তক্ষরণের কারণে মায়ের মৃত্যু হয় বেশি। এজন্য এনএনসি, পিএনসি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় দুই হাজার কেন্দ্রকে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা সেবার আওতায় আনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। প্রতি কেন্দ্রে একজন করে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও) ও দুজন করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) থাকার কথা। আর প্রতি উপজেলায় সাতটি ইউনিয়ন বা তার বেশি ইউনিয়ন থাকলে দুজন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা।
এছাড়া এসএসসিএমও স্কুল স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়নের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাসে চারদিন স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্লাসের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা হয়। দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার সক্রিয় ইউনিয়ন থাকলেও তাতে মাত্র ১ হাজার ৮০০ এসএসিএমও রয়েছেন।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল সেবা এবং ননক্লিনিক্যাল সেবা আলাদা করা প্রয়োজন। পরিবার পরিকল্পনায় যেসব চিকিৎসক রয়েছেন তারা ক্যাডারভুক্ত নন। ফলে তাদের চাকরিজীবনে প্রত্যাশা পূরণ হয় না। এসব বিভাজন ভেঙে দেয়ার জন্য দুই দশক আগে কথা হয়েছিল। ২০০০ সালে স্বাস্থ্যনীতিতে উপজেলা পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল সেবা ও ননক্লিনিক্যাল সেবাকে একীভূত করা হয়। যদিও ২০০৩ সালে সেটি আবার ভেঙে দেয়া হয়। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য গাইনি ও নবজাতক-শিশু বিশেষজ্ঞ এবং এনেসথেসিওলজিস্ট প্রয়োজন। পরিবার পরিকল্পনায় এমন ব্যবস্থা নেই। এখানে জটিলতা রয়েছে। এসব জটিলতা রোধে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ক্লিনিক্যাল বিষয়টিকে পুরোপুরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেয়া উচিত অথবা পরিবার পরিকল্পনায় এসব চিকিৎসককে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর বাইরে জন্মনিয়ন্ত্রণ, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও পুষ্টিসহ নানা বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে পারেন। শুধু ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য নির্ভর করে না।
লোকবলের সংকট নিরসনে কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) খান মো. রেজাউল করিম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়োগ কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কিছু নিয়োগ অপেক্ষমাণ রয়েছে। আবার কিছু লোকবল আমরা নতুন করে নিচ্ছি। সব কাজ ঠিকমতো অগ্রসর হলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।