শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই। নবজাতক ও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। কিন্তু নানা কারণে শতভাগ নবজাতক ও শিশু মায়ের বুকের দুধ পায় না। এমন শিশুদের জন্য প্রয়োজন হয় বিকল্প খাদ্য। সে বিকল্প খাদ্য উৎপাদন ও আমদানির জন্য দেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই নেই সরকারি নিবন্ধন। যদিও এ-সংক্রান্ত আইন হয়েছে আরো নয় বছর আগে। তবে আশার কথা চলতি বছর আটটি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে সরকার। আর এর মাধ্যমে মায়ের দুধের বিকল্প ও শিশুখাদ্য উৎপাদন ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের আওতায় আসতে চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পদক্ষেপের ফলে নিবন্ধনহীন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।
সারা বিশ্বে শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস নামে এ নীতিমালা আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণন নীতিমালা) আইন করে। তবে সে সময় আইনটির পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। ফলে ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নতুন আইন করে সরকার, যার মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের আইনটি বাতিল হয়ে যায়।
এ আইন অনুযায়ী, দেশে বিকল্প শিশুখাদ্য বিপণনবিষয়ক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন)। এ একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান থেকেই বিকল্প শিশু খাদ্য বিপণনের জন্য নিবন্ধন, বিপণনের সামগ্রী ও বিষয়বস্তুর অনুমোদন দেয়া হবে। পাশাপাশি আইনটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে মাঠ পর্যায়েও কাজ করবে আইপিএইচএন।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ সালে আইন হলেও এ সম্পর্কিত বিধি চূড়ান্ত হয় ২০১৭ সালে। বিধি হওয়ার পর পণ্যের অনুমোদন দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে সময় বিধিতে কিছু ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে কার্যক্রম বন্ধ রেখে সেগুলো সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। তবে মন্ত্রণালয় ত্রুটির বিষয়টি বাদ রেখে অনুমোদন দিতে নির্দেশনা দেয়। তখন আইপিএইচএন আবেদন আহ্বান করে। ২০১৮ সালের আগে মাত্র দুটি পণ্যকে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর পরই নিবন্ধনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আবেদন আহ্বান করা হলে এখন পর্যন্ত ১৬টি প্রতিষ্ঠান তাদের ৯৩টি পণ্যের নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র ক্লিনিশিয়ান এবং মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশু খাদ্যপণ্য নিবন্ধন যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ডা. মুরাদ মো. সমশের তবরিছ খান বণিক বার্তাকে বলেন, যাচাই বাছাই শেষে আটটি প্রতিষ্ঠানের ৩০টির বেশি পণ্যকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যের অনুকূলে নিবন্ধন নম্বরও দেয়া হয়েছে। এখন কেবল সনদ দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট পণ্যের মোড়কে কিছু সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এসব ঠিক করা হলে শিগগিরই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদ দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে পরিপূর্ণভাবে আইনের বাস্তবায়ন শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
চলতি মাসেই অনুমোদন পাওয়া আটটি প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে আইপিএইচএন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নেসলে বাংলাদেশ, আবুল খায়ের কনজিউমার প্রডাক্টস, বেবি নিউট্রিশন, ফুডেক্স ইন্টারন্যাশনাল, এইচএস করপোরেশন, জেইএস ইন্টারন্যাশনাল, নিউট্রিপ্যাক ডিস্ট্রিবিউশনস ও নেক্সাস ফার্মাসিউটিক্যালস। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্যের জন্য অনুমোদন পাচ্ছে নেসলে। প্রতিষ্ঠানটি ৪০টির বেশি পণ্যের নিবন্ধন পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। প্রথম দফায় তাদের আটটি পণ্যের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া আরো যে আটটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল সেগুলো হলো প্লাটিনাম ফ্রেন্ডজ, চিটাগং ডেইরি ফুড ইন্ডাস্ট্রি, মাই বয় ইন্টারন্যাশনাল, আরলা ফুডস বাংলাদেশ, জাস করপোরেশন, ভিটালাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রি, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ ও ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
মূলত তিনটি বিষয় দেখে আইনে উল্লেখিত শর্ত সাপেক্ষে পণ্যের অনুমোদন দেয়া হয়। শিশুর জন্য প্রস্তুত করা এ খাদ্য ও এর ব্যবহারের সরঞ্জামাদির তেজস্ক্রিয়তামুক্ত হওয়া সম্পর্কে উৎস দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সনদ আছে কিনা, নিবন্ধনের জন্য সেটি দেখা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট পণ্যের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) সনদও নিবন্ধন পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আইন অনুযায়ী, মায়ের বুকের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্য ও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা শিশুর বাড়তি খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি দায়ী প্রতিষ্ঠানকেও শাস্তির আওতায় আনা যাবে। এসব খাদ্য খেয়ে বা সরঞ্জামাদির ব্যবহারের কারণে কোনো শিশু অসুস্থ হলে বা মারা গেলে প্রস্তুতকারীর ১০ বছরের কারাদণ্ড হবে অথবা ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন হলে তাতেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
শিশুর জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে একান্ত অপরিহার্য হলে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধিত ও রেজিস্ট্রারভুক্ত চিকিৎসক মায়ের বুকের দুধের বিকল্প খাদ্য ব্যবস্থাপত্রে লিখতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণ থাকতে হবে বলেও বিধিতে উল্লেখ রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে বহু প্রতিষ্ঠান মায়ের বুকের দুধের বিকল্প ও শিশু খাদ্য বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত ও আমদানি করছে। আমরা তাদের আইনে আওতায় আনতে শুরু করেছি। চলতি মাসেই আটটি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন সনদ দেয়ার বিষয়ে কার্যক্রম প্রায় শেষ। এসব প্রতিষ্ঠানের খাদ্যের মোড়কে কিছু সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এগুলো ঠিক হলেই তারা সনদ পাবে।
বিজ্ঞাপন বা বিভিন্ন লোভনীয় প্রচারণার মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠানই দেশে ব্যবসা করছে উল্লেখ করে আইপিএইচএন পরিচালক বলেন, আমরা এগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছি। অনৈতিকভাবে যেসব কার্যক্রম প্রতিষ্ঠানগুলো করছে তা বন্ধ করা হচ্ছে। যেহেতু নিবন্ধন দেয়া শুরু হয়েছে, তাই এখন কোনো প্রতিষ্ঠানই নিবন্ধন ছাড়া ও শর্ত না মেনে পণ্য প্রস্তুত ও বিপণন করতে পারবে না।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএনএনসি) ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) পুষ্টি বিষয়ক সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ পায় ৪৭ শতাংশ নবজাতক। আর ছয় মাস পর্যন্ত পুরোপুরি মায়ের বুকের দুধের ওপর নির্ভরশীল শিশুর হার ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে যথাযথ পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ খর্বাকৃতি, ১০ শতাংশ কৃশতা ও বয়স অনুপাতে কম ওজনের সমস্যায় ভুগছে ২৩ শতাংশ শিশু।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের পর শাল দুধ ও ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাবার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ সময় পানিরও দরকার নেই। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টিগুণ মায়ের দুধেই রয়েছে।
বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মায়ের বুকের দুধের বিকল্প বা শিশুখাদ্য সন্তানের জন্য কেনা অভিভাবকের স্বাভাবিক অভ্যাস হওয়া উচিত না বলে সতর্ক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এটা যেখানে-সেখানে বিক্রির বিষয় নয়। শিশুর জন্য বিকল্প এ খাদ্য ইচ্ছা হলেই দোকানে গিয়ে কিনে আনা যাবে এমন পণ্য নয়। তাই এ পণ্যের কোনো প্রচার করা যাবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বিপণন করবে তারাই বলছে, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প নেই। যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধ পায় না, তাদের জন্যই এমন খাবার। তাদের বাঁচাতে এ ব্যবস্থা, সবার জন্য নয়। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত এ পণ্য বেচাকেনায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে যেসব শিশু মায়ের দুধ পায় না, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে বলেও মনে করেন তিনি।