দেশে জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সরকারি ব্যয়ের অবদান দিনে দিনে কমছে। এর বিপরীতে বাড়ছে ব্যক্তিগত ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার/পেমেন্ট। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিকিৎসাসেবায় ২০১৫ সালে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার/পেমেন্ট ছিল ৬৭ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ রাউন্ডের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল এক কর্মশালার আয়োজন করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এর তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমে ২০২০ সালে ২৩ শতাংশে নেমেছে। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৮ ও ২৬ শতাংশ। আবার ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের অবদান ছিল যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৬ শতাংশ।
এ অনুযায়ী জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ব্যয়ে সরকারের অবদান এখন ক্রমান্বয়ে কমছে। এর সঙ্গে বাড়ছে ব্যক্তির নিজস্ব খরচও। এ বাড়তি ব্যয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আর্থসামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে দেশের জনসংখ্যাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এর মধ্যে দরিদ্রতম অংশের জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিজের পকেট থেকে বছরে ব্যয় করছে মাথাপিছু ২০০ টাকা করে। আর শীর্ষ ধনীরা ব্যয় করছে ১ হাজার ৭১৪ টাকা। একই এলাকা বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মাথাপিছু খরচের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, ধনী পরিবারগুলো দরিদ্রদের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি ব্যয় করছে। গ্রামাঞ্চলে শীর্ষ দুই ধনী অংশ ব্যক্তি পর্যায়ে খরচ করে শতকরা ৫৭ টাকা, দরিদ্রতম দুই অংশ খরচ করে ২৫ টাকা। শহরাঞ্চলে এ খরচ যথাক্রমে ৭৬ ও ১২ শতাংশ। সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় খরচের এ হার যথাক্রমে ৮৭ ও ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত খরচ করে ধনী জনগোষ্ঠীর অংশ।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানিয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিপর্যয়মূলক ব্যয় ও দারিদ্র্যের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) পাইলটিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা ঢাকা মহানগরীসহ দেশের আরো ছয়টি জেলায় সম্প্রসারণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কার্ডের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে এবং ১১০টি রোগের (রোগ নির্ণয়, ওষুধ, পথ্যসহ) পূর্ণ চিকিৎসা বিনামূল্যে পাচ্ছে। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তিগত ব্যয় সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পর্যায়ক্রমে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডাটাবেজ বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নের সিংহভাগ মূলত রোগীর নিজের পকেট থেকে আসে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে রোগী নিজের পকেট থেকে যে অর্থ ব্যয় করে, তাকে বাড়তি খরচ বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বলা হয়। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের গড় হার ৩২ শতাংশ।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকার ও দাতা সংস্থার ব্যয়ের হার কমে যাওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের হার বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কোনো মাধ্যমে ব্যয় কমলে অন্য মাধ্যমে বাড়বে এটা স্বাভাবিক। ২০১৫ সালে ব্যক্তি যে বাড়তি ব্যয় করেছে, সেখান থেকে ব্যয় বেড়েছে। একইভাবে সরকার ও দাতা সংস্থার ব্যয়ও কমেছে। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় বেড়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় কোনোভাবেই ৩০ শতাংশের ওপরে যাওয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশে দিন দিন ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় বেড়েছে। এ ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ বিক্রি। ব্যক্তির ব্যয়ের ৬৫ শতাংশই হচ্ছে ওষুধ কেনায়।
স্বাস্থ্য খাতে দেশব্যাপী মোট ব্যয়ের ৩৮ শতাংশ হয় ঢাকা বিভাগে, যা সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে কম খরচ হয় ময়মনসিংহ বিভাগে। বিভাগটিতে ব্যয় হয় ৩ শতাংশ। সরকারি ব্যয়ে মোট খরচের ৯৩ শতাংশ হয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। সম্মিলিতভাবে বাকি ৭ শতাংশ খরচ করে অন্যান্য মন্ত্রণালয়। বেসরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ের ৮৯ শতাংশ আসে ব্যক্তি পর্যায় থেকে। বাকি ১১ শতাংশের উৎস বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশ রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. বর্ধন জং রানা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এ প্রতিবেদনের তথ্য সরকারের নীতি, কৌশল প্রণয়নে ও সেবার মান বাড়াতে কাজে লাগবে। পরিস্থিতি বদলাতে পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি জোরদারের পাশাপাশি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এতে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা। শুধু অর্থায়নই সমস্যার সমাধান নয়। অর্থের যথাযথ ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।