মানহীন ওষুধ বাজারজাতের শঙ্কা: পাঁচ মাসে ৪৬ হাজার ফার্মেসি নিবন্ধন

অতিগুরুত্বপূর্ণ ওষুধ খুচরা পর্যায়ে মানুষের হাতে আসে ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানের মাধ্যমে। এসব ফার্মেসিতে ওষুধ সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে রয়েছে বহুবিধ নিয়মকানুন। নিয়মিতভাবে এসব দেখভাল করার দায়িত্বও রয়েছে নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই না করে দেশে হাজার হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দিচ্ছে সংস্থাটি। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৬ হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মাত্র পাঁচ মাসে এতসংখ্যক ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়ায় ওষুধের মান ও গুণাগুণ বজায় রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আশঙ্কা রয়েছে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন ওষুধ বাজারজাতের।

ওষুধ প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মান শুধু কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন করা না হলে নষ্ট হবে ওষুধের গুণাগুণ। কখনো কখনো তা জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ফার্মেসি অনেক বেশি। প্রতিনিয়তই কর্তৃপক্ষ ফার্মেসির সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ওষুধের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হচ্ছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০-২১) বলা হয়, দেশে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৯টি নিবন্ধনধারী ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি রয়েছে। এরপর ওই বছরের জুন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে আরো ৪৬ হাজার ৮৭৯টি ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়া হয় বলে গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২১-২২) উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট ফার্মেসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৪৮৬। এসব ফার্মেসিকে নির্ধারিত নিয়ম মেনেই নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।

সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা জেলায় ফার্মেসির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় ২৭ হাজার ৮০০ ফার্মেসি রয়েছে। আর সবচেয়ে কম পার্বত্য জেলা বান্দরবানে, ৪৫০। বিভাগভিত্তিক হিসেবে ঢাকার ১৩টি জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ৫৬ হাজার ৯২৭, ময়মনসিংহের চার জেলায় ১০ হাজার ৯০১, সিলেটের চার জেলায় ১০ হাজার ৮৯৬, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৩৬ হাজার ৬৯৫, বরিশালের ছয় জেলায় ১৪ হাজার ৩৮৬, রংপুরের আট জেলায় ১৮ হাজার ৩২৭, খুলনার ১০ জেলায় ২৫ হাজার ৯৯৭ ও রাজশাহীর আট জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ২৮ হাজার ৩৯৯টি।

এসব ফার্মেসিকে ১৯৪৬ সালের ওষুধ আইন (দ্য বেঙ্গল ড্রাগ রুলস ১৯৪৬) অনুযায়ী আবেদনের বিপরীতে নিবন্ধন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর জন্য নির্দিষ্ট কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিয়ম আনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর নিবন্ধন নবায়নও করতে হয় ফার্মেসিগুলোকে। মূলত মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ দুই শ্রেণীতে বর্তমানে নিবন্ধন দিচ্ছে অধিদপ্তর। এর বাইরেও রয়েছে পাইকারি ফার্মেসি, হোমিওপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি, হারবাল খুচরা ফার্মেসি, ইউনানি খুচরা ফার্মেসি, আয়ুর্বেদিক খুচরা ফার্মেসি ও অ্যালোপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি।

ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টি আবেদনের ভিত্তিতে দেয়া হয় বলে মন্তব্য করেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যে বিনা লাইসেন্সে কোনো ওষুধের দোকান থাকবে না। যাদের লাইসেন্স নেই তাদের সময় দেয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় মামলা দেয়া হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সিলগালা করে দোকান বন্ধও করা হয়েছে। এসবের কারণে সম্প্রতি আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিক পেলে তখন নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। কতসংখ্যক ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়া হবে তা বিবেচ্য বিষয় নয়, দেখা হয় যাকে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে তার সবকিছু ঠিক আছে কিনা।’

তিনি জানান, জেলায় নিবন্ধন কমিটির আহ্বায়ক সিভিল সার্জন ও সদস্য সচিব সংশ্লিষ্ট জেলার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। এ কমিটির সুপারিশের আলোকে অধিদপ্তর নিবন্ধন দেয়। একটি ফার্মেসি থেকে অন্যটির দূরত্ব কতটুকু হবে বা এলাকার বিভাজন কেমন হবে সে বিষয়ে নীতিমালা নেই। একটি এলাকায় কত জনসংখ্যার বিপরীতে কতটি ফার্মেসি হবে সে বিষয়েও নিয়ম নেই। ফলে আবেদন সঠিক রয়েছে কিনা তার বাইরে অন্য কিছু দেখার সুযোগ নেই।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২২০টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৪৬টি ইউনানি, ১৫৮টি আয়ুর্বেদিক, ৫১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩৩টি হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে এসব প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২ সালেও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ রফতানি হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো দেশে ফার্মেসির সংখ্যা খুব বেশি বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে দুই লাখের বেশি ফার্মেসি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। একটা বাজারে ফার্মেসির সংখ্যা অনেক থাকে। গ্রাম বা শহর সব এলাকায় ফার্মেসির সংখ্যা খুবই বেশি। ওষুধের মান শুধু উৎপাদন বা কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে না। ফার্মেসির মাধ্যমে সিংহভাগ ওষুধ মানুষের হাতে যায়। সেখানে ওষুধ সংরক্ষণ, বিতরণ বা বিপণন ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিক্রয়কালে ভোক্তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তথ্য দিতে হবে। যেমন ওষুধ কীভাবে সেবন করতে হবে, কীভাবে রাখতে হবে। এগুলোর কোনোটির ব্যত্যয় হলে ওষুধের মান ও কার্যকরিতা নষ্ট হবে। পৃথিবীব্যাপী ওষুধের ফার্মেসির ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম রয়েছে তা আমাদের দেশে দেখা যায় না। সব দেশেই একজন দক্ষ ফার্মাসিস্টের হাতে এসব কাজ হয়। ফার্মেসি আইন-কানুন ও নিয়ম মেনে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চিকিত্সক ব্যবস্থাপত্র দিলে বাকি দায়দায়িত্ব ফার্মেসির। সব ওষুধ একই তাপমাত্রায় রাখা যায় না। এসব বিষয় আমাদের দেশের ফার্মেসিতে মানা হয় না। মানসম্মত কাঁচামাল, মানসম্মত উৎপাদন অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি ফার্মেসির ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ দক্ষ হাতে না হয়।’

প্রতি বছরই দেশে ফার্মেসির সংখ্যা বাড়াচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তবে সে তুলনায় এসব ফার্মেসিকে পরির্দশন ও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনছে না সংস্থাটি। এতে জনস্বাস্থ্যের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বিক্রয়, মান নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়। এতে দিন দিন স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে সাড়ে ৩৫ হাজার ফার্মেসির নিবন্ধন নবায়ন করা হলেও ওই অর্থবছরে পরিদর্শন করা হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার। তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) পরির্দশন করা হয় সাড়ে ৩৬ হাজার ফার্মেসি।

ওষুধের দোকানগুলো সঠিক নিয়ম মানছে কিনা তা তদারকির জন্যই মূলত পরির্দশন করা হয় উল্লেখ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি ঠেকাতে, কোল্ড চেইনের যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্যই ফার্মেসিগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়। দুই বছরের মধ্যে অন্তত একবার হলেও ফার্মেসিগুলোকে পরিদর্শনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়।

ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে দুই-তৃতীয়াংশ ওষুধের দোকানে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। ওষুধ সংবেদনশীল পণ্য। তাপমাত্রার কিছুটা হেরফের হলেই কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। দেশে যে ধরনের ওষুধ রয়েছে তার প্রায় ৯০ শতাংশই ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ওষুধভেদে সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ভিন্নতা রয়েছে। ওষুধ ঠাণ্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়। অধিকাংশ ফার্মেসির বিক্রেতারা ওষুধ সংরক্ষণের যথাযথ নির্দেশনাও জানেন না। ওষুধভেদে সংরক্ষণের জন্য সঠিক তাপমাত্রা নিয়ে তাদের ধারণা নেই।

নিবন্ধন প্রতিযোগিতার বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মান বিবেচনা করে ওষুধের দোকানের নিবন্ধন দেয়া উচিত। যে কেউ আবেদন করলে নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। এসব বিবেচনা করে মডেল ফার্মেসি, মডেল মেডিসিন শপ শ্রেণীতে নিবন্ধন দেয়া শুরু হয়েছিল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ বিতরণ হয়। এতে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ফার্মেসিগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। মাত্র পাঁচ মাসে এতসংখ্যক ফার্মেসি নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: