শরীরের যেকোনো হাড়, পেশি, টেন্ডন, লিগামেন্ট (পেশি ও অস্থির সন্ধিস্থল) ও নরম টিস্যুতে ব্যথা হলে তাকে মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডার (এমএসডিএস) বলে। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে এখন এ ধরনের জটিলতার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এজন্য তাদের অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত কায়িক শ্রমের প্রবণতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, চাষাবাদে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই প্রান্তিক কৃষকদের। দিনরাত উদয়াস্ত শারীরিক পরিশ্রমে ভর করেই চাষাবাদ করে যাচ্ছেন তারা। অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত কায়িক শ্রমে দেহে জন্ম নিচ্ছে নানা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাধি। বিশেষ করে মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডারের প্রাদুর্ভাব এখন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
দেশের কৃষকদের মধ্যে এমএসডিএসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে এখন পর্যন্ত বেশকিছু গবেষণা হয়েছে। প্রতিটিতেই কৃষকদের মধ্যে হাড় ও মাংসপেশির ব্যথার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির তথ্য জানানো হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের ওপর পরিচালিত এমন এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬২ শতাংশ কৃষক কোনো না কোনো ধরনের এমএসডিএসে ভুগছেন। ‘আ ক্রস কাট সার্ভে অন মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডারস অ্যামাং ফার্মার্স ইন সিলেকটেড এরিয়াস অব নর্দার্ন পার্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, গবেষণার আওতাধীন কৃষকদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ (এমএসডিএসে মোট ভুক্তভোগীর ৭১ শতাংশ) পিঠের নিম্নাংশের ব্যথায় ভুগছেন। এছাড়া ঘাড়, হাঁটু ও পায়ের ব্যথায় ভুগছেন যথাক্রমে ৯, ৬ ও ৩ শতাংশ (মোট ভুক্তভোগীর সাড়ে ১৪, ৯ ও সাড়ে ৫ শতাংশ) কৃষক। শারীরিক ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার ভিত্তিতে গবেষণাটি চালানো হয়। এতে অংশ নেয়া কৃষকের ৬৯ শতাংশ দিনে ১০-১৫ ঘণ্টা কৃষিসংশ্লিষ্ট কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থাকেন। প্রতিদিন খেতে ৫-৮ ঘণ্টা কাজ করেন ৬৭ শতাংশ কৃষক। মূলত কম আয়ের ও অতিরিক্ত শ্রমের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের মধ্যেই এমএসডিএসের প্রাদুর্ভাব বেশি।
অনিয়ন্ত্রিত কায়িক শ্রমকেই প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডারের প্রাদুর্ভাব বাড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রান্তিক কৃষকদের অনেকেই কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করেন না। ঝুঁকে বীজ বপন বা চারা রোপণ থেকে শুরু করে চাষাবাদ, বাছাই, কর্তনসহ প্রয়োজনীয় সব কাজ যেভাবে করছেন, তা তাদের দেহের জন্য সুবিধাজনক না। আবার যারা কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করছেন, কম্পনসহ নানা কারণে সমস্যায় পড়ছেন তারা। দেহের কর্মকালীন অবস্থাই তাদের মধ্যে হাড় ও মাংসপেশির ব্যথাসহ এসব সমস্যার সৃষ্টি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৭১ কোটি মানুষ এমএসডিএসে ভুগছে। এটিকে ধরা হয় মানুষের শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ার অন্যতম শীর্ষ কারণ হিসেবে। নেতিবাচক প্রভাব ফেলে মানুষের কর্মদক্ষতা ও মানসিক অবস্থার ওপর। পিঠ ও ঘাড়ের দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড ও ফ্র্যাকচারের মতো সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে এটি। এছাড়া হূদরোগ, ক্যান্সার, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ প্রধান প্রধান অসংক্রামক রোগের সঙ্গেও এমএসডিএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডারস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হায়াতুন নবী। তার মতে, পরিশ্রম যদি অনিয়ন্ত্রিত ও অধিক হয় তাহলে এটি দেখা দেয়। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেই তা হতে পারে। এমনকি ঝুঁকে ভারী কাজ করা বা চেয়ারে বসার অবস্থান সঠিকভাবে না হলেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের অসুস্থতাকে পেশাগত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে পেশাগত রোগ ও ঝুঁকিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে এসব বিষয় থেকে মুক্ত রাখার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে না। ভালো কর্মক্ষেত্রের লোকজনের মধ্যে মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডারস তেমন একটি দেখা যায় না।
চিকিৎসক ও ডব্লিউএইচও বিশেষজ্ঞদের একটি দলের পরিচালিত আরেক গবেষণায়ও অনেকটা একই কথা উঠে এসেছে। এতেও বলা হয়, দেশে এমএসডিএসের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষকসহ কয়েকটি শ্রেণী-পেশার মানুষদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পিঠের নিম্নাংশের ব্যথার মতো জটিলতার প্রাদুর্ভাব এখন গ্রামাঞ্চলে বেশি। ‘প্রিভেলেন্স অব মাস্কুলোস্কেলেটাল কন্ডিশনস অ্যান্ড রিলেটেড ডিজঅ্যাবিলিটি ইন বাংলাদেশী অ্যাডাল্টস: আ ক্রস সেকশনাল ন্যাশনাল সার্ভে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। গবেষণায় উঠে আসে, কৃষকদের মধ্যে হাড় ও মাংসপেশির ব্যথার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ছয় শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে কৃষকদের অবস্থান দ্বিতীয়। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নিম্ন পিঠের ব্যথা। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এ ধরনের ব্যথা পাওয়া গেছে।
খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টির ভারসাম্যকেও এমএসডিএসের পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে দেখা হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তদের কায়িক শ্রম বেশি ও অনিয়ন্ত্রিত। তাদের মধ্যে হাড় ও মাংসপেশির ব্যথা বেশি দেখা যাওয়ার কারণ হলো কায়িক শ্রমের কারণে শরীরে যে পরিমাণ ক্ষয় হচ্ছে, তা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি তারা পান না। এর প্রধান কারণ অসম খাদ্যাভ্যাস। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে প্রধান খাবার বলতে ভাত বোঝানো হয়। ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, ডিম ও সবজি খায়। তবে কেউ কখনই ভাবছে না, একজন মানুষের খাবারের ৫০ শতাংশ হবে কার্বোহাইড্রেট, ৩০ শতাংশ হবে আমিষ ও বাকিটা হবে শাকসবজি, ফলমূল, পানি ও ভিটামিন। এসব বিষয় না বোঝার কারণে তারা পরিশ্রমের পর প্রচুর ভাত খেয়ে থাকে। সকালে যে কৃষক শুধু পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ খাচ্ছে, তারা শুধু কার্বোহাইড্রেট খাবার গ্রহণ করছে। প্রোটিন নেই। তার শরীরে যে ক্ষয় হচ্ছে, তা পূরণের উপায় থাকছে না। অন্যদিকে ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার কম গ্রহণের জন্য তার হাড়গুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। অস্থিগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এজন্য তাদের হাড় ও মাংসপেশির ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে হলে এ জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বয়স, উচ্চতা ও শরীরের ওজন অনুযায়ী পরিশ্রম করার পর সে কী কী খাবে, তা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজের সময়ে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিরতি নিতে হয়। আবার কেউ সারা দিন বা রাতে প্রচুর কাজ করে পরে যদি বিশ্রাম না নেয়, তাহলে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম সালেক বণিক বার্তাকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ও টানা পরিশ্রমের কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। যারা কাজের মধ্যে বিরতি নেন, দিনের নির্দিষ্ট ঘণ্টা কাজের পর প্রয়োজনীয় সময় ঘুমান, তাদের মধ্যে মাস্কুলোস্কেলেটাল জটিলতা তৈরি হয় না। কেউ টানা কয়েকদিন পরিশ্রম করলে তার পরিমিত বিশ্রামও প্রয়োজন। যারা এসব মানছে না, তাদের সমস্যা বেশি হচ্ছে। শরীরের যেকোনো হাড় ও মাংসপেশির ব্যথাকে আমরা এ ডিজঅর্ডার হিসেবে দেখছি।
এ বিশেষজ্ঞের মতে, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হরমোনের সমস্যা, মানসিক সমস্যাও এসব রোগের কারণ হতে পারে। এছাড়া পরিবেশের বিপর্যয় ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে।