দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই শনাক্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। তবে মরণঘাতী ভাইরাসটিতে মৃত্যুর হার ঢাকার তুলনায় বাইরের জেলাগুলোতে বেশি দেখা গিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ভাইরাসটিতে মৃত্যুর হারে এখন শীর্ষে রয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর। এর পরই রয়েছে পার্শ্ববর্তী আরেক জেলা কুষ্টিয়া। মৃত্যুর হারে শীর্ষে থাকা জেলার মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তবে করোনা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত টিকাদান কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে জেলাটি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৮ হাজার ১২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুর হারে শীর্ষে থাকা মেহেরপুরে ৪ হাজার ৭৭০ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। জেলাটিতে ২২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর হারে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অবশ্য ছয় মাস আগে মৃত্যুর হারে শীর্ষে ছিল চাঁদপুর। বর্তমান তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কুষ্টিয়ায় মৃত্যুহার ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত ৮৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে জেলা দুটিতে মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই বলে মনে করছে সেখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনায় মৃত্যুহারের বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মেহেরপুরে মৃত্যুর সংখ্যা স্বাভাবিক রয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগেরই দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল। হূদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যাসহ নানা জটিলতা ছিল। এসব জটিলতার মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের সিংহভাগই ষাটোর্ধ্ব ছিলেন বলে জানান জেলার প্রধান এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
জেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। সরকারি এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে করোনা রোগীদের জন্য ১০০টি শয্যা নির্ধারিত রয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পাঁচটি শয্যা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সংকটাপন্নদের চিকিৎসার জন্য রাখা হলেও নেই কোনো এইচডিইউ (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট) শয্যা নেই। সম্প্রতি হাসপাতালটিতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সংযোগ দেয়ায় কয়েকটি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে মৃত্যুর হারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা কুষ্টিয়া জেলায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জেলার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের জন্য ১৯০টি শয্যা নির্ধারিত রয়েছে। বর্তমানে যার সবক’টিই খালি রয়েছে। তবে চারটি আইসিইউ শয্যার তিনটিতে ও ছয়টি এইচডিইউ শয্যার চারটিতে সংকটাপন্ন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন।
জেলার বাসিন্দাদের মধ্যে রোগ সচেতনতার অভাবে মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কুষ্টিয়ায় পার্শ্ববর্তী জেলার রোগীরা চিকিৎসার জন্য আসেন। ফলে সব সময়ই জেলার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বাড়তি চাপ থাকে। জেলার বাসিন্দাদের রাজশাহী বা ঢাকায় পাঠালেও তারা যেতে চায় না। তবে জেলার সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য যখন হাসপাতালে আসে, তখন চিকিৎসকদের তেমন কিছু করার থাকে না। সরকারি হাসপাতালে সবসময় কিছু সংকটাপন্ন করোনা রোগী ভর্তি থাকেন।
তবে জেলাটিতে করোনার ওমিক্রন ধরনের কারণেও সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে মনে করেন এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তিনি জানান, কয়েকদিন আগে যশোরে তিনটি নমুনায় ওমিক্রনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। যার একটি কুষ্টিয়ার। এতে জেলায় ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর হারে প্রথম ১০ জেলার মধ্যে ছয়টি জেলাই খুলনা বিভাগের। বাকি চারটির মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি ও রংপুর বিভাগে একটি জেলা রয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝিতে করোনার অতিসংক্রামক ধরন ডেল্টার সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময়ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে মৃত্যুর হার শীর্ষে ছিল না। গত জুনের শেষে সারা দেশে গড় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল। ওই সময় ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জে মৃত্যুর হার ৪ শতাংশের বেশি ছিল। সে সময়ের মতো এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তবে শনাক্ত রোগীর তুলনায় মৃত্যুর হার দেশের গড় হারের চেয়েও কম। বর্তমানে সারা দেশে গড় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭৫। আর ঢাকা ও চট্টগ্রামে মৃত্যুর হার যথাক্রমে ১ দশমিক শূন্য ১ ও ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।
করোনায় বর্তমান মৃত্যুর হারে শীর্ষ ১০ জেলার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চাঁদপুর। জেলায় মৃত্যুর হার ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ হার নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ মৃত্যুর হার নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ঝিনাইদহ জেলা। বাকি পাঁচ জেলার মধ্যে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ কুমিল্লা, ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ চুয়াডাঙ্গা, ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বাগেরহাট, ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ নড়াইল ও ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ মৃত্যুর হার ঠাকুরগাঁওয়ে।
মৃত্যুর হার যেসব জেলার বেশি, সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত তিন-চার মাস ধরে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কম। তবে এখন রোগী শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু বাড়ে না। শনাক্ত বৃদ্ধির প্রায় চার সপ্তাহ পর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। এজন্য এখনই ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে মত তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার পর বলা হয় বাড়িতে সাবধানে থাকতে। কিন্তু এটা সমাধান নয়। আক্রান্তকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) রাখতে হবে। সম্প্রতি কারা কারা তার সংস্পর্শে এসেছেন সেটি খুঁজতে হবে। রাজধানীতে রোগী বেশি। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সম্ভব না হলেও অন্য জেলাগুলোতে সম্ভব। কারণ সেখানে বেশি শনাক্ত হলেও তা দুইশর মতো হয়।
এদিকে মৃত্যুহারের শীর্ষ তালিকায় থাকলেও টিকাদান কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। জেলায় এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর ৩৯ শতাংশ। জেলার প্রায় সাড়ে ৩৩ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অথচ গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন জেলার প্রায় ১৩ লাখ মানুষ। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন এর সাড়ে আট লাখ। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের হার ২৬ শতাংশ।
তবে জেলাটিতে টিকা কর্মসূচি গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে দাবি করেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের কারণে টিকা প্রত্যাশীদের সংখ্যা কম ছিল। তবে এখন আবারো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। আমরা ওয়ার্ড ও কমিউনিটি ক্লিনিকেও করোনার টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি।
সরকারের করোনার টিকাবিষয়ক তথ্য বলছে, দেশে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট কোটি প্রথম ডোজ এবং সাড়ে পাঁচ কোটির কিছু বেশি দ্বিতীয় ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। করোনার টিকা পাবেন এমন জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ প্রথম ও ৪০ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেবে সরকার। সেই হিসেবে দেশের ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে।