চলতি মাসে অনুষ্ঠিত ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর কাটা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এমন প্রার্থীদের নম্বর কাটার ক্ষেত্রে ভুল করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এতে ভালো ফল করেও অনেক শিক্ষার্থী সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ হারাচ্ছেন পছন্দের মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ।
গত ফেব্রুয়ারিতে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। বিজ্ঞপ্তিতে ২০২২ সালে এইচএসসি, এ লেভেল ও সমমান, ২০২০ সালে এসএসসি, ও লেভেল ও সমমান অথবা ২০২১ সালে এইচএসসি, এ লেভেল ও সমমান এবং ২০১৯ সালে এসএসসি, ও লেভেল ও সমমান পরীক্ষায় নির্দিষ্ট ফল নিয়ে উত্তীর্ণদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আহ্বান জানানো হয়।
পরীক্ষায় ১০০ এবং এইচএসসি ও এসএসসিতে প্রাপ্ত ফল মিলিয়ে ২০০ নম্বরসহ ৩০০ নম্বরের যোগফলে মেধা তালিকা প্রস্তুত করার কথাও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তির ৯ নম্বর নির্দেশনা অনুযায়ী, দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এমন প্রার্থীদের প্রাপ্ত ফলাফলে নম্বর কর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যারা পূর্ববর্তী বছরের এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়েছেন সেসব পরীক্ষার্থীর মোট প্রাপ্ত নম্বর থেকে পাঁচ নম্বর বাদ দেয়া হবে। একই সঙ্গে কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ অথবা ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন এমন শিক্ষার্থীর মোট প্রাপ্ত নম্বর থেকে কাটা হবে আট নম্বর। তবে এবারের ভর্তি পরীক্ষায় এ শর্ত অধিদপ্তর মানেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফল প্রকাশের পর গত শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল ইউনিটে ভর্তির সুযোগ পেয়েও ভর্তি হননি এমন পরীক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে নিয়ম অনুযায়ী তাদের মোট নম্বর থেকে ৫ নম্বর কাটার কথা থাকলেও বাদ দেয়া হয়েছে আট নম্বর। যেহেতু তারা কোনো কলেজ বা ইউনিটে ভর্তি হননি, তাই ৯ নম্বর নির্দেশনার দ্বিতীয় অংশ নয় বরং প্রথম অংশ অনুযায়ী তাদের ফল হিসাব করার কথা। কিন্তু সেটি হয়নি। এ বিষয়ে কয়েকজন ভর্তিচ্ছু মহাপরিচালকের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।
অন্তত পাঁচ ভর্তিচ্ছু বণিক বার্তাকে জানান, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পর তারা বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। তবে তারা ভর্তি হননি। কেউ ভর্তি না হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিলে শর্ত অনুযায়ী পাঁচ নম্বর বাদ দেয়ার কথা। তবে কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে আট নম্বর বাদ দিয়ে ফল প্রকাশ করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভর্তিচ্ছু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের কারণে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমার নির্ধারিত ২০০ নম্বর। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭৩ পেয়েছি। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কারণে পাঁচ নম্বর কাটা হলে আমার ২৬৮ পাওয়ার কথা। তবে আমি পেয়েছি ২৬৫ নম্বর। গত বছর আমি যে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম সেখানে ভর্তি হইনি। ভর্তি হলে আট নম্বর বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত হতো। কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে আমি সরকারি বা বেসরকারি কোনো মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছি না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। যে মেডিকেল কলেজে গত বছর ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম, সেখানে ভর্তি হইনি মর্মে প্রত্যায়ন আনতে বলা হয়েছে। আমি সেই কাগজ জমা দিয়েছি। ফল সংশোধনের ক্ষেত্রে তবু কর্তৃপক্ষের সাড়া মেলেনি।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, ফলাফল থেকে অতিরিক্ত নম্বর কর্তনের বিষয়টি ইচ্ছাকৃত নয়। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর কোথাও ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলে সেই তথ্য সার্ভারে থাকে। পরবর্তী বছরে আবার আবেদন করলে আগে কোথাও ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা স্বয়ংক্রিভাবে যাচাই হয়ে যায়। তবে নির্বাচিত হওয়ার পরও ভর্তি হয়েছিলেন কিনা তার তথ্য থাকে না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবেদনের সময় ভর্তি আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। সে অনুযায়ী তারা তথ্যও দিয়েছিলেন। তবু সার্ভার থেকে কেবল নির্বাচিত হওয়ার তথ্য নিয়ে ফল তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্য যাচাই করা হয়নি।
ছোট ভাইয়ের ফল নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আমিরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে বিষয়টি জানানোর পর তারা বলেন, যে সরকারি মেডিকেলে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিল সেখানে ভর্তি হয়নি, এমন চিঠি নিয়ে আসতে হবে। এরপর সেই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের স্বাক্ষরিত চিঠিও নিয়ে আসা হয়। তবে অধিদপ্তর এখনো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ২৭ মার্চ থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তির তারিখ ঘোষণা করেছে। আগামী ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় নির্বাচিত ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিসংক্রান্ত নির্দেশনা পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেলে ৪ হাজার ৩৫০ জন পরীক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৯৫৭ জন ছেলে ও ২ হাজার ৩৯৩ জন মেয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন।
এখন পর্যন্ত এমন সমস্যা নিয়ে ২০-২৫ জন শিক্ষার্থীর অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি বলেন, ‘গত বছর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেলে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকে পরীক্ষা দিয়েছেন। এমন অন্তত ৭০০ জন আবার ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এখন ফল সংশোধন করলে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ফল সংশোধন করলে যে শিক্ষার্থী প্রথম দিককার মেডিকেলে নির্বাচিত হয়েছে সে পিছিয়ে যাবে। আবার সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত সরকারি মেডিকেল কলেজে যে নির্বাচিত হয়েছিল সে বাদ যাবে। অনেকে ক্রমানুসারে বেসরকারি মেডিকেল থেকেও বাদ পড়বে। যারা নির্বাচিত হয়েছে তাদের জন্যও ন্যয়সংগত হবে না। তবে এখন ভর্তির জন্য যাদের প্রথমে আহ্বান করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত ৩০০-৪০০ ভর্তি হবে না। সে সময় নম্বর কর্তনে যে শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে তাদের যুক্ত করা হবে।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিঞা বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনলাইনে আবেদনের প্রযুক্তিগত ভুল রয়েছে কিনা সে বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। আমরা চাই, কোনো শিক্ষার্থী যেন ক্ষতির শিকার না হয়। যারা সত্যি ভুক্তভোগী তাদের জন্য কী করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’