মৌলিক স্যানিটেশন নেই ৫২% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

শিশুর সুস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের অন্যতম অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয় স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন বা মৌলিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় অধ্যয়নরত শিশুদের জন্য এখনো এ সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো মৌলিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়নি।

মৌলিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে কয়েকটি পরিষেবার উপস্থিতি অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, যেকোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মৌলিক স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিতের জন্য ছেলে ও মেয়েদের আলাদা এবং ব্যবহার উপযোগী শৌচাগার থাকা আবশ্যক। এর সঙ্গে আরো বেশকিছু মৌলিক পরিষেবার উপস্থিতি অপরিহার্য। এগুলো হলো পাইপলাইনযুক্ত নির্গমন ব্যবস্থার সমন্বিত শৌচাগার, সেপটিক ট্যাংক বা পিট ল্যাট্রিন, বায়ু চলাচল উপযোগী উন্নত পিট ল্যাট্রিন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রবহমান পানির (রানিং ওয়াটার) উপস্থিতি।

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ৫২ শতাংশেই এসব পরিষেবার কোনো না কোনোটির অনুপস্থিতি রয়েছে। ইউনিসেফের পর্যবেক্ষণে তা উঠে এসেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ। এছাড়া মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা বেসিক হাইজিন ব্যবস্থা নেই ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২১: অন মাই মাইন্ড; প্রমোটিং, প্রটেকটিং অ্যান্ড কেয়ারিং ফর চিলড্রেনস মেন্টাল হেলথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইউনিসেফের এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ভাষ্য অনুযায়ী, স্যানিটেশন ব্যবস্থা বলতে মানবদেহের বর্জ্য নিরাপদ নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা এবং সুবিধার উপস্থিতিকে বোঝায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌলিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি শিশুর নানা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য পয়োনিষ্কাশন ও মৌলিক পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মৌলিক এসব সুবিধা না থাকায় সেখানকার শিক্ষার্থীদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল থেকে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা হলো সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। মৌলিক পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা না থাকলে তারা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবকাঠামোভিত্তিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশু ও নারীদের জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থায় সঠিক অবকাঠামো দেখা যায় না। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ সুপেয় পানির উপস্থিতি ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, গৃহস্থালি এবং বিদ্যালয়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে গৃহস্থালির স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো। বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছে। প্রাথমিকের চেয়ে সব ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এগিয়ে রয়েছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে ৭৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আর মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে এ হার ৯৩ শতাংশ।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মৌলিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অনুপস্থিতির বড় একটি নিদর্শন হলো লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার নাগ রাজারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাদের জন্য পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। পার্শ্ববর্তী একটি মাদ্রাসার শৌচাগার ব্যবহার করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তবে সেখানেও মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়তে হয়। নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি সম্প্রতি নতুন একটি ভবনও পেয়েছে। নবনির্মিত ভবনটিতেও শৌচাগার বা প্রক্ষালন কক্ষের ব্যবস্থা নেই। উপজেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়টিতে পয়োনিষ্কাশন বা স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

পয়োনিষ্কাশনের সঙ্গে শিশুর ডায়রিয়া ও খর্বকায়ত্বের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে ইউনিসেফ জানিয়েছে, অনুন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে ডায়রিয়া, অন্ত্রের প্রদাহ ও কৃমির মতো সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির কারণে বছরে ৪২০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। এ অর্থ দেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশের সমান।

আগের একটি প্রতিবেদনেও শহর ও গ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, উন্মুক্ত জায়গায় মল ত্যাগ বন্ধে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা হাইজিন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো থাকলেও সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস খুবই কম।

পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার বিষয়ে কোনো আপস করা যাবে না উল্লেখ করে ডব্লিউএইচওর সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক শৌচাগার থাকতে হবে। স্যানিটেশনের সমস্যা থাকলে তাতে সংক্রামক রোগগুলো বেশি বিস্তার লাভ করে। কৃমি, টাইফয়েড, কলেরা ও পেটে পীড়ার বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। চর্ম রোগ হয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে

স্কুলগামী শিশুদের এ রোগগুলো বেশি হয়। একই সঙ্গে শিশুরা রোগের কষ্ট পেলেও অভিভাবকের কাছে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ফলে রোগগুলো বড় আকার ধারণ করে। এসব কারণে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। আর তাতে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও বাড়তে থাকে।

সরকারের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি ২০২০ (এপিএসসি-২০২০) অনুযায়ী, দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬। আর সরকারি, বেসরকারি, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, এনজিও স্কুল, শিশু কল্যাণ বিদ্যালয়সহ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার। এগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১ লাখ ৫৫ হাজারের কিছু বেশি।

তবে ইউনিসেফের তথ্যের সঙ্গে একমত নন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বর্তমানে কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে পয়োনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানি সরবরাহের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সুশান্ত রায় বণিক বার্তাকে জানান, বর্তমানে চতুর্থ প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পসহ তিনটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্যানিটেশন এবং পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্য অবকাঠামোর কাজ করছে। এরই মধ্যে সাড়ে ৩৯ হাজার বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির উেসর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় এসেছে ২৮ হাজার বিদ্যালয়। অনেক বিদ্যালয়ে আগে থেকেই সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালে। দেশে শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতায় আনার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনটিতে সঠিক চিত্র উঠে আসেনি দাবি করেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমরা এখন চেষ্টা করছি যে পানি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়, তা শতভাগ নিরাপদ রাখতে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন) ড. উত্তম কুমার দাশ বলেন, ইউনিসেফ সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়ে এ প্রতিবেদন করেছে, তাই সংখ্যাটি এমন হতে পারে। কিন্তু প্রায় শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক করে নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: