আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আহতদের অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী সহিংসতায় শুধু রাজধানীতেই আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার জনকে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে বেশির ভাগই ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন। তবে গুরুতর আহতদের অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন। রাজধানীর ছয়টি বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার ও গতকাল ঘুরে জানা যায়, আন্দোলনকে ঘিরে আহত দুই শতাধিক রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক। আবার কারো প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনকে ঘিরে আহত ৫১৮ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ জনকে ভর্তি করা হয়। ওই সময়ে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয় ৩১ জনের। আর ছোট পর্যায়ে ১৫০ জনের অস্ত্রোপচার হয়েছে। পাঁচদিনে ২১টি মৃতদেহ আসে এ হাসপাতালে। আন্দোলনকে ঘিরে দ্বিতীয় ধাপে ৪ থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত দেড় শতাধিক আহত ব্যক্তি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে ২৮ জনকে ভর্তি করা হয়। আর মৃতদেহ আসে ২০টি। দুই দফায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে এখনো ৪১ জন চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালের ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, আহত সব রোগীই গুলিবিদ্ধ। এদের অনেকের দুই থেকে পাঁচবার পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। ভর্তি এসব রোগী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর, শিশুসহ বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষ।
জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব রোগী এখনো চিকিৎসাধীন তাদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। এসব রোগীর আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। ফলে হাসপাতাল থেকেই তাদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় বহন করা হচ্ছে। তারা যেন চিকিৎসা করাতে এসে আর্থিক বিপর্যয়ে না পড়েন তার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আন্দোলনে আহত সব রোগীকে একই ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।’
আন্দোলনকে ঘিরে শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে আহত রোগী এসেছে দেড় সহস্রাধিক। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে তিন শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৪৪ জন এখনো চিকিৎসাধীন। জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েকজনের হাত ও পা কেটে ফেলা হয়েছে।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. বদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে আন্দোলনের দিনগুলোয় দুই ব্যক্তির মরদেহ নিয়ে আসা হয়। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এখন যারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের কারো হাত ও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কেননা গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাদের হাত বা পায়ের ধমনি ও শিরা ছিঁড়ে যায়। এমনভাবে তাদের ধমনি ও শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে তা জোড়া লাগানো সম্ভব হয়নি। এতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে পচন ধরে। এ অবস্থায় তাদের বাঁচাতে এসব অঙ্গ কেটে ফেলার বিকল্প ছিল না। এখনো অনেক রোগী আশঙ্কামুক্ত নন।’
একইভাবে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গত এক মাসে আন্দোলনকে ঘিরে অন্তত পাঁচ শতাধিক আহত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ১৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত চোখে আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নেন ৩৯৫ জন। এর মধ্যে ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয় ৩০৮ জনকে। সে সময়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে ২৫৬টি। আর ৪ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ২৮৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। ভর্তি করা হয় ২৬৯ জনকে। এদের মধ্যে ১৮৮ জনের বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। বর্তমানে ৩০ জন হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এসব রোগী সংঘর্ষ ও সহিংসতায় আহত। একেকজনের একেক ধরনের চোখের আঘাত। বহু রোগী দৃষ্টিশক্তি হরিয়ে ফেলেছেন। যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের চোখে মূলত ছররা গুলি, রাবার বুলেট ও গুলি লেগেছিল। টিয়ার গ্যাসের শেল বা কাঁদানে গ্যাসের কারণেও অনেকে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।’
আন্দোলনকে ঘিরে আহত হয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দুই দফায় ভর্তি হয়েছেন ৪০ জন। এদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন থোরাসিক সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. নাজমুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যাদের ভর্তি করা হয়েছে তারা সবাই গুলিবিদ্ধ। বর্তমানে সাতজন চিকিৎসাধীন। ভর্তি রোগীদের বুকে, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ডের নিচে, বুকের ওপরেসহ শরীরের ওপরের অংশে গুলি লেগেছিল।’
মিরপুরের কিশোর ইয়ামিন তালুকদার (ছদ্মনাম) ৪ আগস্ট আহত হয়। সরকার পতনের আন্দোলনে গেলে এইচএসসির এ পরীক্ষার্থীর ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করা হয় এবং পেটে গুলি লাগে বলে জানান তার বাবা। ছুরিকাঘাতের কারণে ঘাড়ে পাঁচটি সেলাই দিতে হয়েছে। তবে পেটের বাম পাশে লাগা গুলিটি বের হয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যায় এ কিশোর। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য তাকে আরো কয়েকদিন হাসপাতালে রাখা হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দুই দফায় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হাসপাতালটিতে রোগী আসে প্রায় তিনশ। এর মধ্যে যাদের ভর্তি করা হয়েছে তাদের সিংহভাগই সুস্থ হয়ে চলে গেছেন। বর্তমানে পাঁচজন চিকিৎসাধীন।
আহত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ শতাধিক রোগী। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম সবুজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্দোলনকে ঘিরে আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছিলেন মোট ৮০ জন। শুরুতে ছয়জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বর্তমানে পাঁচজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’