রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু আরো প্রাণঘাতী রূপ নেয়ার আশঙ্কা

সারা দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে। চাপ পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। চলতি বছরে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এতদিন রাজধানী ঢাকার তুলনায় সারা দেশে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল দ্বিগুণ। এখন ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা রাজধানীকেও ছাড়িয়েছে।

সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩০ জুলাই থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত পাঁচদিনে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৭১৪ জন। আর রাজধানীর বাইরে সারা দেশে ভর্তি হয়েছে ৭ হাজার ৫৯৫ জন। সব মিলিয়ে এ সময়ে শনাক্তকৃত ১৩ হাজার ৩০৯ রোগীর মধ্যে ৫৭ শতাংশই ভর্তি হয়েছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে।

রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতাও। এছাড়া ঢাকার বাইরের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার বিষয়ে অভিজ্ঞতাও কম। ফলে রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় ডেঙ্গু রোগ আরো প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার বড় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌এতদিন রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল শহরে। এখন গ্রামে রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে স্বাস্থ্য অবকাঠমো খুব একটা সাজানো না থাকলেও এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু গ্রামে ভালো অবকাঠামো থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জরুরি ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। সামনের দিনগুলোয় অবস্থার আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।’

দেশের অন্তত ১০টি জেলার সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এসব হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু ওয়ার্ডের নির্ধারিত সংখ্যার শয্যায় পূরণ হচ্ছে না রোগীর চাহিদা। অনেক হাসপাতালেই দেখা গেছে, শয্যার অভাবে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা। একইভাবে রয়েছে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও। কোনো কোনো রোগীরা হাসপাতালে আসছে নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে। অনেক রোগী আসছে শ্বাসকষ্ট, গর্ভকালীন জটিলতা, রক্তক্ষরণসহ বহু শারীরিক জটিলতা নিয়ে। দেশের সিংহভাগ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও তাদের জরুরি সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে করে তুলেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব।

রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির সংখ্যায় শীর্ষ জেলাগুলোর অন্যতম কক্সবাজার, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর। সরজমিনে দেখা গেছে, এসব হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল। চাঁদপুর সদর হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গুর জন্য দুটি ওয়ার্ডে (পুরুষ ও নারী) শয্যা সংখ্যা ২৪। শয্যার চেয়ে রোগী অনেক বেশি। ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছে অনেকে। ২৫০ শয্যা সক্ষমতার হাসপাতালে দৈনিক রোগী (সাধারণ ও ডেঙ্গু) থাকছে কমপক্ষে ৪৫০।

হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল বলে জানালেন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, বিশেষ করে রাতে চিকিৎসক না থাকায় রাতে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে না।

পর্যটন জেলা কক্সবাজারে রোগীর সংখ্যা বেশি। জেলা শহরের ঘোনারপাড়া, নতুন বাহারছড়া, বাহারছড়া ও চকরিয়ার বিএমচর এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী বেশি আসছেন হাসপাতালে। বিশেষ করে জেলার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরগুলোয় ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে দ্রুতগতিতে। গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে ৪ হাজার ২০৮ জন। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৭৯৪ জনই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য।

লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গত এক মাসে সাতশোর বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসাসেবা দেয়ায় বেগ পেতে হচ্ছে জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে। লক্ষ্মীপুর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সিংহভাগই নারী ও শিশু। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় ডায়রিয়া ওয়ার্ডেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতিও রয়েছে হাসপাতালটিতে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০০ শয্যার হাসপাতালে ৫০ শয্যারও জনবল নেই। গাইনি, কার্ডিওলজি, মেডিসিন এবং নাক, কান ও গলা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্টের পদে রয়েছেন মাত্র দুজন। মোট ২৩টি চিকিৎসকের পদের বিপরীতে রয়েছেন ১৬ জন। সক্ষমতার তিন গুণের বেশি রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হচ্ছে।

হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, এখানে তারা প্রয়োজনমতো বিশেষায়িত চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী বেশি আসছে। তাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা জায়গা করা হলেও বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হচ্ছে।’

ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন (এনএলএম) বলছে, ডেঙ্গুর জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিরাময়কারী ওষুধ নেই। রোগীদের বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা সর্বোচ্চ সহায়ক। ডেঙ্গুর জটিল পর্যায় থেকে রোগীকে স্বাভাবিকে আনা ও সুস্থ করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ভিত্তিই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জটিল ডেঙ্গু রোগীকেও সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তবে চিকিৎসা হতে হবে যথাসময়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বুঝতেই সময় লেগে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসতে দেরি হচ্ছে। শুরু থেকেই আমরা বলে এসেছি, যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রস্তুত রাখতে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে। ডেঙ্গু এখন সারা দেশের রোগ। জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাপনাগুলো রাখতে হবে। সরকারি হাসপাতালে অভিযোগের শেষ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২ হাজার ৫৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ সময় মারা গেছে ১০ জন। দেশে চলতি বছর এ পর্যন্ত ২৮৩ জনের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে। এর আগে গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়েছিল। হাসপাতালে গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্য ঢাকার ১ হাজার ১০১ জন। ঢাকার বাইরের ১ হাজার ৪৮৮ জন। সারা দেশে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৫৯ হাজার ৭১৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ঢাকায় ৩২ হাজার ৫৬২ জন ও ঢাকার বাইরে ২৭ হাজার ১৫৪ জন। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে জুলাইয়ে; ২০৪ জনের। চলতি মাসের প্রথম তিনদিনে মৃত্যু হয়েছে মোট ৩২ জনের। এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। এছাড়া ২০২০ সালে ৭ জন ও ২০২১ সালে মারা যায় ১০৫ জন। আর ২০২২ সালে মারা গিয়েছিল ২৮১ জন ডেঙ্গু রোগী।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে বলে দাবি করলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সারা দেশের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালেও যে গাইডলাইনে চিকিৎসা দেয়া হয়, উপজেলার হাসপাতালেও সেই গাইডলাইনে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসার কোনো তারতম্য হাসপাতাল ভেদে হয় না। প্রয়োজন বিবেচনায় কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসক, শয্যা বাড়ানো হয়েছে। ওষুধের কোনো সংকট দেখা যায়নি।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার কক্সবাজার, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের প্রতিনিধিরা)

Source: Bonik Barta

Share the Post: