দেশে উচ্চগতিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ। সবাই যখন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ব্যস্ত, তখন অনেকটা নীরবেই বিস্তার লাভ করছে ডেঙ্গু। শুরুতে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু তা এখন দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। চলতি মাসের প্রথম ১৯ দিনে রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ মাসে রাজধানীতে যে হারে সংক্রমণ ঘটেছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে রাজধানীর বাইরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপের দুর্বলতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ১৫ হাজার ৭০১ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ২৪১ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে রাজধানীর বাইরে ৫৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে নয়, মার্চে ১৩, এপ্রিলে তিন, মে মাসে ৪৩, জুনে ২৭২, জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ ও সেপ্টেম্বরের ১৯ দিনে ৫ হাজার ৩৪৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বলছে, চলতি মাসের ১৯ দিনে রাজধানীতে ৪ হাজার ১৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা চলতি বছর এ পর্যন্ত রাজধানীতে আক্রান্তের ৩০ শতাংশ। এ মাসে রাজধানীর বাইরে ৯০০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা গত নয় মাসে আক্রান্তের ৫০ শতাংশ। মূলত গত মাসে রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বিস্তার হতে শুরু করে। তবে এ মাসে রাজধানীর চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে অন্যান্য এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেছে।
এ মাসের শুরুতে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, শরীয়তপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নওগাঁ, পটুয়াখালী, বরিশাল, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে। রোগী বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সে সময় সারা দেশে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়, আক্রান্তের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক।
বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তরা এর অতিসংক্রামক ধরন ডেন-৩-এ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এ ধরনটির কারণে দ্রুত রোগীর অবস্থার অবনতি হয়। এতে মৃত্যুর হার বেশি। এর কারণেই মূলত সারা দেশে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। মশাবাহিত এ রোগ দেশের সব জেলায় যেভাবে ছড়িয়েছে, তা অন্য সময় দেখা যায়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে।
তবে ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই জানিয়ে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেন, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে বেশি মনোযোগী হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তেমন কার্যক্রম দেখা যায়নি। পৌরসভা, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সব এলাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নির্মূল করতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগের বিষয়টি করোনা মহামারীর কারণে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়নি। যতটুকু পর্যবেক্ষণ ছিল তাও রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে এ সুযোগে জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গুর বিস্তার হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, এডিস ও এলবোপিকটাস মশা মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী। যখনই রোগী বাড়ছে তখনই নজরে আসছে। সারা দেশে একযোগে সপ্তাহব্যাপী এডিস মশা নিধনের কর্মসূচি পালন করা গেলে তা নির্মূল হতো। কিন্তু সেটিও করা হয়নি। এ বিষয়ে পরিকল্পনার অভাবের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুর সঙ্গে নগরায়ণের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। মূলত স্থানীয় সরকার বিভাগই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা অপেশাদারিত্বের সঙ্গে এ কার্যক্রমটি করছে। পরিকল্পনাও ঠিক হচ্ছে না। কীটতত্ত্ববিদ, রক্তরোগ, ভাইরোলজিস্টসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দল নিয়ে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। তবে সেটি করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি ১২টি সরকারি হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। তবে রোগতত্ত্ববিদদের অভিযোগ, ডেঙ্গু চিকিৎসায় এখন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
অন্যদিকে কীটতত্ত্ববিদ ও ঢাকা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ বলেন, শুধু সচেতনতা বাড়িয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে না। এজন্য কেমিক্যাল পদক্ষেপ প্রয়োজন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য নিয়ে বাড়িতে গিয়ে সেখানে মশা নিধনে পদক্ষেপ নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতারণা করছে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক কোনো প্রযুক্তি বা পরিকল্পনা স্থানীয় সরকার বিভাগের নেই। কেবল জমা পানি ফেলে দেয়াই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উপায় নয়।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগের অসচেতনতাকে দুষছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুকে কখনই রাজধানী বা রাজধানীর বাইরের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। যেখানেই এডিস মশা থাকবে সেখানেই ডেঙ্গু রোগ ছড়াবে। মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ করে। বিষয়টি সম্পূর্ণ তাদের কার্যক্রমের আওতায়। আমরা চিকিৎসা ও গবেষণা করে থাকি। আগেই ডেঙ্গু বাড়ার বিষয়টি দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।