রোগীর প্রতি অবহেলার দুই–তৃতীয়াংশ অভিযোগই ঠিক

দেশে চিকিৎসাসেবার পরিধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন বাড়ছে চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতার বিষয়ে রোগীর অসন্তুষ্টি। এ বিষয়ে নজরদারি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) গত এক দশকে নিষ্পত্তি করা অভিযোগের দুই-তৃতীয়াংশই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। চিকিৎসাসেবার বিষয়ে সরকারের যথাযথ তদারকি এবং বিএমডিসির কর্তৃত্ব ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা।

বিএমডিসির তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে এ বছরের ১ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪৭ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাদীর পক্ষ থেকে প্রত্যাহার করাসহ ৭১টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রত্যাহার করা ২০টি বাদ দিলে এক দশকে নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১টি। এগুলোর মধ্যে ৩১টি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়। শতকরা হিসাবে তা ৬১ শতাংশ। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া ১৬ জন চিকিৎসকের নিবন্ধন বিভিন্ন মেয়াদে স্থগিত এবং একজনের ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়েছে। নথিভুক্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ ধরনের কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হার ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সতর্কতার নোটিশ পেয়েছেন ১৮ শতাংশ চিকিৎসক এবং ১০ শতাংশকে ভর্ৎসনা করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৯ শতাংশ চিকিৎসককে দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পেশাগত নিবন্ধন, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, জার্নাল অনুমোদন ও উচ্চতর ডিগ্রির স্বীকৃতির পাশাপাশি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ওঠা পেশাগত অনৈতিকতার অভিযোগ নিষ্পত্তি করে বিএমডিসি। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ পেলে বিএমডিসি প্রথমে তা লিখিতভাবে অভিযুক্ত চিকিৎসককে পাঠায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের লিখিত জবাব অভিযোগকারীকে জানানো হয়। এরপর বিএমডিসি চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে। নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত ও অভিযোগের শুনানি হয়।

দেশের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা বলছেন, শুধু চিকিৎসকেরাই নৈতিকতা রক্ষার বিশেষ শপথ নিয়ে তাঁদের পেশায় আসেন। কিন্তু বাণিজ্যিক মনোভাব ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মতো বিভিন্ন কারণে অনেক চিকিৎসকের পেশাগত নৈতিকতা প্রশ্নের মুখে। বিএমডিসিতে যাওয়া গত কয়েক বছরের অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর কারণ অদক্ষতা বা অজ্ঞতা নয়; বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা দায়িত্বের প্রতি শতভাগ আন্তরিক ছিলেন না। ছিল সতর্কতার অভাব ও তাড়াহুড়া করার প্রবণতা।

বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. লিয়াকত হোসেন তাঁদের কাছে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনো ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তা নথিভুক্ত করতে কয়েক দিন সময় লাগে। কেননা এতে অনেক কিছু লিখতে হয়। এরপর কার্যনির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিয়ে শৃঙ্খলা কমিটিতে পাঠানো হয়।’

রেজিস্ট্রার জানান, বর্তমানে ২৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত কার্যক্রম চলছে এবং ৪৯টি অভিযোগ শৃঙ্খলা কমিটিতে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ প্রায়ই দেখা যায়। দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চিকিৎসায় অবহেলা বাড়ছে। এতে গত কয়েক দশকে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা উইলির জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চিকিৎসকের সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন অর্ধেকের বেশি রোগী। ‘ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশনশিপ: এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, চিকিৎসকের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ৮৫ শতাংশই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। আর রোগীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব ৬৭ শতাংশের। চিকিৎসকের আন্তরিকতা, পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, রোগীর নিজের মতো ও তার কথা বিস্তারিত শোনা, ভালোভাবে ব্যবস্থাপত্র বুঝিয়ে দেওয়া, চিকিৎসকের ওপর আস্থার বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া হয় ওই গবেষণায়। এতে জনসাধারণ, রোগী ও চিকিৎসক—সবারই দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে চিকিৎসা নৈতিকতার চর্চা সন্তোষজনক নয় বলে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে।

প্রতিকারের একটি নমুনা:

শাস্তি দেওয়ার পর একই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আবার দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পেয়েছে বিএমডিসি। অধ্যাপক ডা. জাহীর আল আমিন ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ এই শল্যচিকিৎসক ২০২০ সালে এক রোগীর বাঁ কানের পরিবর্তে ডান কানে অস্ত্রোপচার করেন। এতে রোগীর শারীরিক-মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়। অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে বিএমডিসি ডা. জাহীরের নিবন্ধন ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে এক বছরের জন্য স্থগিত করে। তাঁর বিরুদ্ধে চলতি বছরের আগস্টে আবার ‘ভুল অস্ত্রোপচারে’ রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে। অস্ত্রোপচারটি হয়েছে রাজধানীর কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নার্সিং হোমে। জাহীর আল আমিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলে আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার লিয়াকত হোসেন। তিনি বলেন, ‘একাধিকবার কারও বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি ঘোষণা করে বিএমডিসি। তাঁর নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করা হয়। তবে এর বাইরে বিএমডিসির আর কিছু করার এখতিয়ার নেই।’

ক্ষতিপূরণ পেতে হলে আদালত:

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন-সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিচার বলতে বিএমডিসির এখতিয়ার হচ্ছে চিকিৎসকের পেশাগত নৈতিকতা দেখা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যা যা করণীয়, সেগুলো নিয়মমাফিক করা হয়েছে কি না, তা অনুসন্ধান করা। চিকিৎসায় অবহেলা মানেই অনৈতিকতা। একজন রোগী চিকিৎসকের কাছে তাঁর জীবনের সুরক্ষার জন্য আসেন। তবে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ দাবি করলে তাঁকে দেওয়ানি আদালতে যেতে হবে। কেননা বিএমডিসির দায়িত্ব-কর্তব্য শুধু পেশাগত নৈতিকতার বিচার করা।’

ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, প্রচলিত ধারণা ও বাস্তবতার তুলনায় গত এক দশকে বিএমডিসিতে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর সংখ্যা খুবই কম। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘বাইরে কোনো সমঝোতা না হয়ে যদি বিএমডিসিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তি বেশি হতো, তাহলে চিকিৎসার মানও বাড়ত। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে সরকারের তদারকির অভাব রয়েছে।’

সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে নানা সময় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে পেশাগত অবহেলার অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। সে তুলনায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এত কম হওয়ার বিষয়ে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেউ অভিযোগ দিতে চাইলে তাঁকে ঢাকায় আসতে হয়। আর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও প্রমাণ অনেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। ফলে অভিযোগের সংখ্যা কম। আবার অনলাইনে অভিযোগের সুযোগ দেওয়া হলে এত অভিযোগ আসবে যে তার সুরাহা বিএমডিসি করে উঠতে পারবে না।’

বিএমডিসির সভাপতি বলেন, ‘সংখ্যায় কম হলেও যে অভিযোগগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিচার হয় বস্তুনিষ্ঠ। উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার হার দুই-তৃতীয়াংশ হওয়া মানেই এটা নয় যে সার্বিকভাবে চিকিৎসকের বড় একটি অংশ দায়িত্ব পালনে উদাসীন।’

Share the Post: