রোগী ভর্তির ব্যবস্থা নেই দেশের একমাত্র থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

রাজধানী ঢাকায় সরকারিভাবে সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অভাবে মানুষ ভিড় করছে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে। ফলে এসব টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ রোগের উপসর্গ থেকে শুরু করে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসা করতে হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজধানীতে দেশের একমাত্র থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ‘তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। যেখানে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রোগী ভর্তির সুবিধা নেই। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সঠিক পদক্ষেপ থাকলে এটিকে সহজেই মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন নগরস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় স্থানীয় সরকার বিভাগ নাগরিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্বে আছে। রাজধানীতেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের। তবে স্থানীয় সরকার বিভাগের সমন্বিত পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় নগরের বাসিন্দারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। ফলে জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে জনসাধারণকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত বিশেষায়িত হাসপাতালে আসতে হচ্ছে। রাজধানীতে মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রাথমিক সেবার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো হাসপাতাল নেই।

স্বাধীনতার পরপর প্রতিষ্ঠিত তেঁজগাও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরবর্তী সময়ে বিলুপ্ত করা হয়নি। দেশের সব থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নীত হলেও এটি একমাত্র থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে রয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর রোগী ভর্তি করা হলেও পরবর্তী সময়ে রোগী ভর্তির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি হাসপাতালটিতে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ১৯৭৩ সালে ২৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। বর্তমানে রাজধানীর মধ্যে এক মাত্রমাত্র উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও দেশের একমাত্র থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এটি।

ঢাকা জেলার সাঁতারকুল, বাড্ডা, ভাটারা, বেরাইদ, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, ডুমনি, মান্ডা, মাতুয়াইল, ডেমরা, দক্ষিণগাঁও, নাসিরাবাদ, শ্যামপুর, দনিয়া, সারুলিয়া, সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন নিয়ে এ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার কাজ করত। যদিও এ ১৭টি ইউনিয়নের আটটি ঢাকা উত্তর করপোরেশন ও নয়টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যুক্ত হয়েছে। এর আগে কখনই ওইসব এলাকায় ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনো অবকাঠামো ছিল না। এসব এলাকায় পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন মৌসুমে রোগ প্রতিরোধ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কার্যক্রম চালানো হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়ে। বর্তমানে এসব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ২৫ একর জমির বড় অংশই এখন দখলের বাইরে। আর বেশি কিছু জায়গায় রয়েছে অবৈধ স্থাপনা।

জানা যায়, রাজধানীর এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৈনিক গড়ে ৩০০ রোগী বহির্বিভাগের সেবা নিচ্ছে। সরকারের অন্যান্য হাসপাতালের মতো বহির্বিভাগ দিনের সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। শুধু জরুরি বিভাগের সেবা ২৪ ঘণ্টা চলে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠার সময় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। ৩১ শয্যার এ হাসপাতালের জমির কিছু অংশ পরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়ে যায়। একসময় কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরিয়ে আনা হয়। কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী, তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনেই কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরিয়ে আনা হয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে যে স্থানে একতলা টিনশেড ভবনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে তাও নির্মাণ করা হয় সরিয়ে আনার পর। একতলা টিনশেড ভবনে কার্যক্রম শুরুর পর অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রাখা যায়নি। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জমির কিছু অংশে জাতীয় নাক, কান ও গলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিছু জমি দেয়া হয় ঢাকা ওয়াসাকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতেই জড়তা রয়েছে। এখানে পরিষ্কারভাবে অনেক কিছুই বলা হয়নি। যেহেতু নগরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের এমন সিদ্ধান্ত রয়েছে, ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে উজ্জীবিত করতে চায় না। আবার স্থানীয় সরকারের কাছে অবকাঠামোটা ছেড়ে দেবে তা-ও হচ্ছে না। এখানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ভুক্তভোগী হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীরা। কমপ্লেক্সটিকে রাজধানীর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল করা যায়।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও নিউমোনিয়া, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ, মূত্রনালির সংক্রমণ, চর্ম ও যৌন রোগ, প্রসূতিদের প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসা, দন্তরোগ, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস, শিশুরোগ, ডায়রিয়া ও আমাশয়, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ের কনসালটেশন দেয়া হয়। জরুরি বিভাগে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীর চিকিৎসা, ওআরটি (ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি) কর্নারের মাধ্যমে ডায়রিয়া চিকিৎসা, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের চিকিৎসা, জরায়ুর মুখ পরীক্ষা করা হয়।

তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গাজী আহমাদ হাসান বণিক বার্তাকে জানান, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে বর্তমান ২১ জন চিকিৎসক, ২০ জন নার্স, ১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। যদিও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে নিরাপত্তাকর্মী, এমএলএসএস ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন যথাক্রমে একজন করে তিনজন। হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধি করা জরুরি। তেজগাঁও শিল্প এলাকা হওয়ায় পরিপূর্ণভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে।

এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কখনই রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল না বলে দাবি করেন ঢাকার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌রোগী ভর্তির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। দেশের কোনো সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যকর নয়। তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে তেমনি ধরা যায়। তবে এখানে শুরু থেকেই বহির্বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। কখনো রোগী ভর্তি করা হয়নি।

ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মো. সাহাবুদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইনডোর বিভাগ চালু করা বা রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করার কোনো পরিকল্পনা নেই। ঢাকা শহরে ৩১ শয্যার কোনো হাসপাতাল করা হবে না। হলে সেগুলো বিশেষায়িত বা টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল রাজধানীতে করার আর সুযোগ নেই। এখানে আগামীতে ভবন নির্মাণ করে বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয় চলে আসবে। তখনো বহির্বিভাগের কার্যক্রম চলবে। এই কমপ্লেক্সের আবাসিক এলাকায় যেসব অবৈধ স্থাপনা রয়েছে সেগুলো উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: