অণুজীবদের বিনাশ বা বৃদ্ধি রোধের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যান্টিবায়োটিককে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হলেও বর্তমানে অযৌক্তিক ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে অণুজীবগুলো এ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। তাত্ক্ষণিক কার্যকারিতা পেতে বাংলাদেশেও অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। দেশে ৭৬ শতাংশ রোগীকে কোনো ধরনের রোগ নিরীক্ষণ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে বলে উঠে এসেছে খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায়। একইভাবে অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধও ব্যাপক হারে দেয়া হচ্ছে রোগ নিরীক্ষণ ছাড়াই।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ‘সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস অব ইউজ অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অ্যামাং অ্যালোপ্যাথিক প্র্যাকটিশনারস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, দেশে ৫২ শতাংশ রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। সারা দেশ থেকে মোট সাড়ে ১০ হাজার চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। তবে এসব ব্যবস্থাপত্র থেকে গবেষণার জন্য সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ব্যবস্থাপত্র চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য রাখা হয়। এতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের বিষয়টি তুলে আনা হয়।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, রোগীর কাছ থেকে পাওয়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে রোগ নিরীক্ষা না করেই অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেয়া হয়েছে ৭৬ শতাংশ রোগীকে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থাপত্রে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ পাওয়া গেছে। রোগ নিরীক্ষা না করেই অ্যান্টিভাইরাল দেয়া হয়েছে ৮৪ শতাংশ, অ্যান্টিফাঙ্গাল দেয়া হয়েছে ৮০ শতাংশ ও অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক দেয়া হয়েছে ৭৭ শতাংশ ব্যবস্থাপত্রে।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের চেয়ে অযোগ্য চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের পরামর্শ বেশি পাওয়া যায়। রোগ নির্ণয় ছাড়াই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিবিহীন চিকিৎসকের ৯৭ শতাংশ ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের পরামর্শ পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী (ন্যূনতম এমবিবিএস) চিকিৎসকের ক্ষেত্রে রোগ নিরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার হার ৮৩ শতাংশ। আর রোগ নির্ণয় ছাড়া যোগ্য চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ ৭৩ শতাংশ ও অযোগ্য চিকিৎসক পরামর্শ দিচ্ছেন ৯২ শতাংশ রোগীকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। তবে সংক্রমণ আছে কিনা তা বোঝার জন্য অন্তত সিবিসি বা সামগ্রিক রক্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। চিকিৎসকরা সিবিসির মাধ্যমে একটি সাধারণ ধারণা পেয়ে থাকেন। রোগীর শরীর কোনো সংক্রমণের শিকার হয়েছে কিনা, রক্তকণিকা স্বাভাবিক আছে কিনা, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন এসব বুঝতে পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ। এতে অন্তত একটি অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা যায়। এরপর ব্লাড কালচার পরীক্ষা করা হয়। এতে কী ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছে ও সেই জীবাণুর বিপক্ষে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর তা জানা যায়। শরীরে যে জীবাণুই আক্রমণ করুক না কেন তা প্রায় সব সময় রক্তে চলে আসে। ব্লাড কালচারের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিবায়োটিকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তবে এ পরীক্ষার ফলাফল পেতে ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়।
দেখা যায়, একদিনের ডায়রিয়া হলেই অনেক চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ডায়রিয়া কোনো সংক্রমণের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে হয়েছে তা পরীক্ষা ছাড়া বোঝা মুশকিল। ডায়রিয়া সাধারণত তিনদিনে আপনাআপনি কমে যেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঠাণ্ডার সর্দি-কাশি হলেও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেয়।
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগ নিরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসকরা কেমন অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন তা দেখা হয়েছে। যেসব চিকিৎসক রোগ নিরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই। তবে যারা রোগ নিরীক্ষা না করেই অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিচ্ছেন তা শতভাগ ভুল তাও বলা যাবে না। এমনো হতে পারে ওই রোগী চিকিৎসকের কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার চিকিৎসার জন্য এসেছেন। অনেক ক্ষেত্রে কোনো রোগ নিরীক্ষা ছাড়াও চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ ও সময়সীমা বিবেচনায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
রোগ নিরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের পরামর্শ দেয়ার বিষয়ে এমন গবেষণা দেশে আগে দেখা যায়নি উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল বণিক বার্তাকে জানান, সুনির্দিষ্ট রোগভিত্তিক খরচের তথ্য বা ডিজিজেস স্পেসিফিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট যে গবেষণা করেছে তাতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের প্রয়োগও দেখা হয়েছে। দেশে মূলত মূল ধারার অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেয়ার ধরন বিশ্লেষণ করা হয়। ন্যূনতম এমবিবিএস ডিগ্রি ও উচ্চতর ডিগ্রির চিকিৎসকদের যোগ্যতাসম্পন্ন বলা হয়েছে। আর এসব যাদের নেই সেসব চিকিৎসককে অযোগ্য বলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে পল্লী চিকিৎসক, হাতুড়ে চিকিৎসক, দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রান্তিক অঞ্চলে যারা চিকিৎসা দেন তারা। তবে চিকিৎসকের যোগ্যতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম এমবিবিএস ডিগ্রিকে ধরা হয়েছে। কত শতাংশ রোগী রোগ নিরীক্ষণ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ পেয়েছেন এমন গবেষণা দেশে আগে হয়নি। তবে বিষয়টি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক তা বুঝতে হলে আরো গবেষণার প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় বলা হয়, শিশুদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন চিকিৎসকরাই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের জন্য রোগীকে পরামর্শ দিচ্ছেন। ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীরা নিবন্ধনহীন চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, জীবাণুর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধী হওয়া বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) তখনই ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও পরজীবী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং ওষুধের প্রতি সাড়া না দিয়ে সংক্রমণের চিকিৎসা কঠিন করে তোলে। এতে রোগের বিস্তার, গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ হওয়া। যেকোনো দেশে যেকোনো বয়সী মানুষকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রভাবিত করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ স্বাভাবিকভাবে ঘটলেও মানুষ অযৌক্তিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের বিষয়টি আরো ত্বরান্বিত করেছে। এতে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ যেমন নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, গনোরিয়া ও সালমোনেলোসিস চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের শীর্ষ ১০টি হুমকির মধ্যে একটি এএমআর।
অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ কেন দেয়া হয়েছে তা শুধু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখে বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে চিকিৎসকরা সাধারণত রোগের নাম, রোগ নিরীক্ষা ও অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরীক্ষার পর কী অবস্থা তা ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করেন না। দেশে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধনকৃত চিকিৎসক সোয়া লাখের কিছু বেশি। এ লোকসংখ্যা ছাড়াও আরো কয়েক লাখ মানুষ চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা করছেন। গ্রামে, বস্তিতে, দুর্গম এলাকায় বহু চিকিৎসক পাওয়া যায়। এসব বিষয় গবেষণায় বিবেচনা করতে হবে। রোগীর শরীরে কোনো সংক্রমণ না থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার কথা নয়। এজন্য রোগীর সঙ্গে কথা বলতে হবে, কোনো উপসর্গ আছে কিনা তা দেখতে হবে। এরপর রোগ নিরীক্ষা করতে হবে। অনেক কারণে সংক্রমণ ঘটে। কিছু নিয়মিত ও বিশেষ পরীক্ষা করে তবেই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। ব্লাড কালচার এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল দেয়ার আগে দু-একটি পরীক্ষা অন্তত করার কথা। তবে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে এসব দেখা যায় না। চিকিৎসক যদি মনে করেন তবে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে সংক্রমণের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য প্রটোকলও রয়েছে, কোন রোগের জন্য কী অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে। গাইডলাইনও রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও বলেছে, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কারো কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না করতে। তবে দেশের ফার্মেসিগুলো এমন নির্দেশনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানে না। অযৌক্তিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রয়োগের ফলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্র্যান্স গড়ে ওঠার সমস্যাটি ছোট নয়।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের আদর্শ মানদণ্ড দেখা হয় না উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ আছে কিনা তা ব্লাড কালচার করে বোঝা যায়। আমার ধারণা, যারা চিকিৎসক তারা এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন। আমার বিশ্বাস চিকিৎসকরা পরীক্ষা করেন। চিকিৎসকের কাছে জ্বর ও রক্তক্ষরণের বিষয়ে রোগীরা বেশি আসেন। এতে চিকিৎসকরা রোগীর আরোগ্যের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। একই সঙ্গে রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক না পেলে ওই চিকিৎসকের কাছে আবারো আসতে চান না। এখানে যারা চিকিৎসা নেন তাদের মানসিকতাও দায়ী। উন্নত বিশ্বে এমনটি হয় না। তাদের একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সেখানে চাইলেই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না। বিকল্প জায়গা থেকেও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না। ওইসব দেশের চিকিৎসকরা ন্যূনতম ৪৮ ঘণ্টা রোগীকে অপেক্ষা করতে বলেন। তবে বাংলাদেশে এমন করলে ওই চিকিৎসক রোগী হারাবেন। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত কম অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়, কারণ সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহ কম। কেউ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করবে না। একই সঙ্গে কোনো প্রমাণ না পেয়ে কোনো চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেবেন না। এমন একটি সুষ্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।