জ্বলছে নিজ ঘর-বাড়ি, জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম, কুণ্ডলি পাকিয়ে কালো ধোঁয়া যেন পুরো পৃথিবীর আকাশকেই ঢেকে ফেলেছে। ৩০ উর্ধ্ব আব্দুল আলীমের পরিবারের এগারো জনের মধ্যে নয় জনকেই মেরে ফেলা হয়েছে। বেঁচে আছেন তারা দুই ভাই। বেঁচে থাকলেও তারা নেই এক সঙ্গে, ছোট ভাইটা কোথায় আছে তা জানেন না তিনি। এক পাশে সীমান্ত অন্যপাশে নিশ্চিত মৃত্যু। তারপরও বাঁচার তাগিদে ছুটে চলা অজানা পথে, অপরিচিত অঙ্গনে, ভিন দেশে। আলীমের মতোই এমন গল্প প্রায় রোহিঙ্গাদের।
নিজের মা-বাবা, স্ত্রী, এক ছেলে, তিন বোন, দুই ভাইকে হারিয়েছেন আব্দুল আলীম। তিন বোনের মধ্যে দুই জনকেই নিজের চোখের সামনে ধর্ষণের শিকার হতে দেখেছেন। পৈশাচিকতা শেষে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। ছোট ভাইয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের দিকে ছুটেছিলেন তিনি। তার মতই হাজার হাজার মানুষের ঢলের মধ্যে কখন যেন হাত থেকে ফসকে গেছে ছোট্ট ভাইটি। আজ দুই বছর পরও আতঙ্কে আছেন আলীম। মাঝে মধ্যে এখনও আঁতকে ওঠেন তিনি। এই গল্পটি কক্সবাজারের উখিয়ার একটি ক্যাম্পের আশ্রয় নেওয়া এক রোহিঙ্গার জীবনের গল্প।
মানবতার বিরুদ্ধাচারণ করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট কলঙ্কজনক এক অধ্যায়ের সূচনা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুই বছর ধরে আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এ বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন বাংলাদেশই নানামুখি সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৮ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী এ দেশে এসেছিলেন। এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে তাদের ৩২টি ক্যাম্পে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাস করেন। শরণার্থীদের এ আগমনের কারণে মানবিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আন্তরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সংকট দিন দিন বাড়বে বলে মনে করছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, মানবধিকারকর্মী, শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হলেও তা বার বার ভেস্তে যায়। প্রতিবারই রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। রোহিঙ্গারা জানান, নিশ্চিত মৃত্যুর চেয়ে এমন মানবেতর জীবনযাপন করাই ভালো। নিজ দেশে ফেরত গেলে তাদের আবারও নির্যাতন করা হবে, মেরে ফেলা হবে এমন আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহকে পুঁজি করে নগদে লাভ লুটে নিচ্ছে কিনা বিদেশি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্র তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের আগে যাচাইয়ের জন্য ২৯ জুলাই ছয় হাজার পরিবারের ২৫ হাজার রোহিঙ্গার নতুন একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। এ নিয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পেল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে প্রায় আট হাজারের পরিচয় যাচাই করা হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে দুই দেশ ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে চুক্তি করে। ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরুর দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলের ফেরার কথা ছিল গত বছরের ১৫ নভেম্বর। কিন্তু রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি না হওয়ায় এ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
এদিকে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য যে অর্থ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে আসছে তা ধীরে ধীরে কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা জানায়, আন্তর্জাতিক মহলের অগ্রহ কমে যাচ্ছে বিধায় রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থও কম আসছে। এতে করে আগামীতে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা খরচ করতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৫০টি সংস্থা রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য নিয়ে কাজ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন।
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য চেয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও বাংলাদেশে সরকার। কিন্তু এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা শরণার্থীদের জন্য খরচ করেছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আবদুল মোমেন জানিয়েছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের দারিদ্র্যতা ৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় আড়াই হাজার পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এর বাইরে আরো এক হাজার ৩০০ পরিবার ঝুঁকিতে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের রান্নার কাজে ব্যবহিৃত হয় প্রায় ৭ হাজার টন জ্বালানি কাঠ। রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৬ হাজার বনভূমি উজার করে বসতি স্থাপন করেছে। এতে বন বিভাগের ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দিন দিনে বেড়েই চলছে। এক হিসেবে দেখা যায়, গত দুই বছরে জন্ম নিয়েছে ৯১ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। প্রতিদিন গড়ে বাড়ছে ১২৫ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মানবিক নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং মানব পাচার সংক্রান্ত নিরাপত্তার ঝুঁকির মতো ঝুঁকি।
জানা যায়, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা অনেকেই অসুস্থ হয়ে ও হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে পানিবাহিত রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার টন মানুষের বর্জ্য রাখার জায়গা নেই রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত শেডে।
অপরদিকে রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফে এখন স্থানীয় নাগরিকরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায় ভয়াবহ ধস নামতে পারে এমন আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি উন্নয়ন সংস্থার উখিয়ায় কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে একুশে টেলিভিশনের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের কোন রোগ মহামারির আকার ধারণ করতে সময় লাগবে না। যেমন ধরুন গুটি বসন্ত, ডেঙ্গু যদি রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে দেখা দেয় তা হলে তা পুরো কক্সবাজারে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। এতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাংলাদেশিরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।’
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে নাকি কমছে এমনটি জানতে চাইলে এ নৃবিজ্ঞানী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিন দিন বাড়বে। কেননা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন গড়ে ১২৫ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। এতে করে এক সময় ঐ ক্যাম্পের জায়গা সংকুলান হবে না। দিন দিন নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে।’ রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমন একটা সচেতন নয়। যেমন মিয়ানমারে থাকাকালীন তারা শুধু ঔষুধ বলতে পুশকিংকে বুঝতেন। তাদের চিকিৎসকরা তাদেরকে ইনজেকশন পুশ করতেন। তাদেরকে ট্যাবলেট দিলে তাতে তারা সন্তুষ্ট হন না। কারণ তারা ট্যাবলেটকে ঔষুধ মনে করেন না।’
পরিবেশের বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের কারণে পরিবেশের যে বিপর্যয় হচ্ছে তা কেউ চোখে না দেখলে বুঝতে পারবে না।’ বাংলাদেশীরাই পরিচয়ের সংকটে ভোগেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় বাংলাদেশীরা চলার পথে আট থেকে দশবারও চেকিং’র শিকার হন এতে তারা পরিচয়হীনতায় ভোগেন। কোন ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না থাকলে তাদেরকে রোহিঙ্গা বলে সম্মোধন করা হয়।’
সম্প্রতি সরকার রোহিঙ্গাদরকে জন্য নির্ধারিত ক্যাম্প থেকে বের হওয়া আইনগত নিষিদ্ধ করলে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। প্রান্তিক এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য’র মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের পক্ষে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয় অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাইরের দিক থেকে এ শরণার্থী ক্যাম্প শান্ত মনে হলেও ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চলছে। দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের বেলায় ক্যাম্পের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের আঁধারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই অস্থিরতার মূল কারণ এমনটি জানা যায়। এতে একটা সময় রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ক্যাম্প পরিচালনা করবে বলে শঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। গত দুই বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে ৪৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ৪৩টি। রয়েছে ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক চোরাচালানের অভিযোগও। খুন, ডাকাতি, চুরি, ধর্ষণ, ইয়াবা, মানবপাচার, নির্যাতন, জমি দখলসহ ১৭ ধরণের অপরাধে জড়িত হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। তাদের হাতে উঠেছে আগ্নয়াস্ত্র তারা গড়ে তুলেছে ছোট ছোট বাহিনী।
এসবের মধ্যেই রোহিঙ্গারা মোবাইল সেবা নিচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এর মধ্যেই এ সুবিধা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সে লক্ষে কাজ করছে মোবাইল অপারেটরগুলি। কিন্তু তা কতটুকু কর্যকরী হবে এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মোবাইল সেবা দেওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা কিভাবে এ সেবা পেতেন তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান রোহিঙ্গাদের দ্বারা সংঘঠিত অপরাধ অস্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘একটা গ্রুপ বাইরে থেকে এসেছে। এলিয়ন বলা যায়। এখানে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রয়েছে। তাদের এ ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। আমি মনে করি আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা উচিৎ ছিল। তবে এ সব মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমাদের আছে। আমাদের এখনই উচিৎ তাদের নিয়ন্ত্রণ করা। তবে এটা সত্য কক্সবাজারের মতো ছোট একটা নাজুক পরিবেশে এখানে আরও ক্ষতি হচ্ছে। তারপরও আমি বলি এটা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা আমাদের আছে।’
রোহিঙ্গারা যেসব অপরাধ করছে তাতে দেশের নিরাপত্তা কতটুকু হুমকিতে পড়েছে এমনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক বটে তবে নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয় যে তারা বিভিণ্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি একটা বিষয় দেখি আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে যে অবস্থান নিয়েছি তারপরও বিষয়টি নিয়ে কঠোরভাবে আলোচনা করা উচিত।’
রোহিঙ্গার ইস্যুতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু বিষয়ে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে। আমরা ভাসানর চরে তাদের পাঠাবো কি পাঠাবো না। আমরা শুধু কথা বলছি। আমরা মহানুভবতা দেখিয়ে বিপদে পরছি কিনা তা বিবেচনা করতে হবে।’
সরকারের নমনীয়তাকে তারা পেয়ে বসেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু তাদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারিনি। আমরা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো পরামর্শে আমরাই বিপদে পড়েছি। চীন একটা ডেট ঠিক করল আমরা সে ডেট অনুযায়ী তাদের প্রত্যাবসনের জন্য আয়োজন করালাম কিন্তু হলো না। আমার এ বিষয়টির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। রোহিঙ্গাদেরও কিন্তু প্রস্তুত করা যায়নি। সবটুকু জোর দিয়ে মিয়ানমারকে আলোচনায় এনে বিষয়টির সুরাহা করতে হবে। সমঝোতার মাধ্যমে করতে গিয়ে ভাসান চরে নিয়ে গেলে কিন্তু হবে না। এতে প্রত্যাবসন পিছিয়ে যাবে।’
তাদের দেশে ফেরত পাঠানো না গেলে বাংলাদেশ কতটুকু হুমকিতে পড়তে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এমনটি হলে তার কোন সমাধান দেখছি না। এটা হলে বেশ খারাপ হবে। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে তারা যেন তাদের লোকগুলোকে নিয়ে যায়। রাতের নিরাপত্তাহীনতার বিষয় তিনি বলেন, এখানে প্রয়োজনে ফোর্স বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
গেল মাসে ২৫ তারিখ দুই বছর পূর্তিতে তাদের অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মহাসমাবেশ হলো তাদের একটা বিস্ফোরণ তবে এখানে যাদের ইন্ধন রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর হতে হবে।’
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উপর পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন৷ তিনি চান, রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তরের বাংলাদেশের যে পরিকল্পনা, তাতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সমর্থন দিক, নয়তো (সংস্থাগুলো) দেশ ছেড়ে চলে যাক৷
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয়, রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে পাঠানোর এখনই সময়৷ তবে ঐ দ্বীপে সব রোহিঙ্গাকে পাঠানো সম্ভব নয়।’
গত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে শক্ত কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার ব্যাপারে সমর্থন চেয়েছেন। বাংলাদেশকে ওআইসিসহ মুসলিম দেশের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের মিত্র দেশগুলো নতুন অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়েছে। বৃহৎ রাষ্ট্র দুটির মিয়ানমারে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। দেশটিতে প্রভাব ধরে রাখার জন্য উভয় দেশ মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে। রাশিয়াও একই রকম অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে তিনটি দেশই আগ্রহী, যা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে, যা আমাদের কূটনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘ভারত, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ যে সমর্থন পাওয়ার কথা ছিল তা পাচ্ছে না। বাংলাদেশের কুটনীতিকে আরও স্পষ্ট করে দেখাতে হবে। কুটনীতির মাধ্যমে পাপ দিতে হবে। এতে আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কুটনীতির মাধ্যমে বিষয়টি আরও জোরদার করতে হবে। বিষয়টিকে খুব শক্ত করে দেখাতে হবে।
মায়ানমারের দিক থেকে সাড়া পাওয়া না গেলে কঠোর হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্যই ভাবতে হবে যে মিয়ানমার ও রকম কোন রাষ্ট্র নয় যে বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিবে। বিষয়টি মুখে আশ্বাস দিলে হবে না। একটা সুষ্ঠু সমাধান দরকার। বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে রোহিঙ্গার জন্য বাংলাদেশ আসলে কতটুকু চাপ নিতে পারবে। সামনেই তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা এখানে বিষয়টি খুব জোরদারভাবে তুলতে হবে। বিষয়টির জন্য আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজকে রিচ করা উচিত।’
রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার সাহায্য কমে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাহায্য কমে যাওয়ার কারণ হলো সব দেশেই তো এখন বেশ শরনার্থী রয়েছে।’
শুধু কূটনীতির কারণে বিষয়টি সমাধান হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু কূটনীতির মাধ্যমে এ বিষয়টি সমাধান করতে হবে। অন্য কোন উপায় দেখছি না।’