পাকস্থলীর ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) ভর্তি হয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব কামাল বেপারী। বরিশালের গৌরনদীর গেরাকুল গ্রামের এ বৃদ্ধ গত বছরের ২৯ আগস্ট ভর্তি হলেও পাকস্থলীতে অস্ত্রোপচারের দিন নির্ধারণ হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে তাকে হাসপাতালে রেখে ১৪ সেপ্টেম্বর বাড়ি গিয়েছিলেন ছেলে রিয়াদ বেপারী। ১৭ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে এসে বাবাকে না পেয়ে কর্তৃপক্ষকে জানান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওইদিনই লিফটের গর্ত থেকে কামাল বেপারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন রিয়াদ বেপারী। ঘটনা তদন্তে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ আট মাস। এ সময়ের মধ্যে থানা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটিও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে অভিযোগ। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টার দিকে হাসপাতালের নবম তলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নির্ধারিত শয্যায় এসে বাবা কামাল বেপারীকে পাননি রিয়াদ। ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা তাকে জানান, দুদিন আগে অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর ফজরের নামাজ পড়ে এসে সর্বশেষ নিজ শয্যায় বসেছিলেন বৃদ্ধ কামাল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাইরে গেলেও আর ফিরে আসেননি। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানালে হাসপাতালের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) পর্যালোচনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের নবম তলা থেকে লিফটে উঠছেন কামাল বেপারী। বাটন চাপলে খুলে যায় লিফটের দরজা কিন্তু লিফট দাঁড়ায়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগে তিনি প্রবেশ করতেই নিচে পড়ে যান। এর দুদিন পর বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করা হয় লিফটের নিচের গর্ত থেকে।
ঘটনা তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথক কমিটি। যদিও তদন্তকালীন কেউই ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে জানিয়েছেন রিয়াদ বেপারী। তাই তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তার। হাসপাতালে ভর্তি রোগী নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর বাবার মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টিকেও কর্তৃপক্ষের অবহেলা বলে মনে করছেন তিনি। রিয়াদ বেপারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভর্তি রোগীর বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ছিল। কেমোথেরাপি দেয়ার পর বাবা বেশ সুস্থ ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন অস্ত্রোপচারের জন্য। এর মধ্যে দুদিন ধরে একজন ভর্তি রোগী তার শয্যায় নেই, বিষয়টি আমলেই নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এমনকি আমাদেরও খবর দেয়নি। উল্টো আমি গিয়ে বাবাকে না পেয়ে তাদের জানাই। তারপর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর মামলা করা হলেও থানা থেকে অথবা তদন্ত কমিটির কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’
লিফটের গর্তে পড়ে ভর্তি রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ব্যবস্থাপনার অভাব খুঁজে পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি। যদিও এ কমিটি তদন্তকালীন ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আর হাসপাতালের পক্ষ থেকে যে তদন্ত হয়েছে তাতে অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা লিফটম্যান ও প্রকৌশলী নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনার দিন হয়তো লিফটে কারিগরি ত্রুটি ছিল। তবে যেদিন তদন্ত করা হয়েছে সেদিন ত্রুটি পাওয়া যায়নি। সিসিটিভিতে রোগীকে পড়তে দেখা গেছে, তাতে মনে হয়েছে লিফটে কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। ভর্তি রোগী ২৪ ঘণ্টাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে রাখার নিয়ম। রোগী কোথায় গেল, থাকল বা কী খেল সেটা নথিভুক্ত থাকতে হবে। ক্যান্সার হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগী ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে ঘাটতি পাওয়া গেছে। দুদিন ধরে রোগী নেই—এ বিষয়টি তাৎক্ষণিক তারা কর্তৃপক্ষকে জানায়নি। কর্তব্যরত চিকিৎসকও গিয়ে শয্যায় রোগীকে পাননি। তারা ফাইলে লিখে রেখেছিল যে রোগীকে শয্যায় পাওয়া যায়নি। এর পরের দিনও চিকিৎসক এসে রোগীকে পাননি। অবহেলার বিষয়টিতে কর্তব্যরত নার্সদের কারণ দর্শানো হয়েছিল। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তদন্তে ওয়ার্ডের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে লিফট নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, লিফটের সামনে সার্বক্ষণিক আনসার ও লিফটম্যান নিযুক্ত করা। প্রয়োজনীয় লোকবল বাড়ানো, যারা ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকবেন এবং সার্বক্ষণিক রোগীদের পর্যবেক্ষণে রাখবেন। যেন কোনো রোগীকে মুহূর্তের জন্য না দেখলে তাৎক্ষণিক কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়া যায়।
অনিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা ও অব্যবস্থাপনায় রোগী মৃত্যুর বিষয়টি বিশ্বব্যাপী প্রধান ১০টি মৃত্যু ও শারীরিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার একটি উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, বছরে অনিরাপদ সেবার কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর হাসপাতালে ১৩ কোটি ৪০ লাখ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ লাখের বেশি মৃত্যু হয়। হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের ত্রুটি, ব্যবস্থাপত্রের ভুল ও রোগী ব্যবস্থাপনায় অবহেলা যেন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগী ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে রোগীরা নতুন করে ক্ষতির মুখোমুখি হন। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, হাসপাতালে একজন রোগীর উচ্চমানের নিরাপদ যত্ন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা, রোগ নিরীক্ষা, চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের আবাসনও অতিগুরুত্বপূর্ণ। কেননা রোগীদের আবাসন, হাসপাতাল ভবন অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তির অবহেলার কারণে রোগীর ক্ষতি অন্য সেবাকে মূল্যহীন করে দেয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বাংলাদেশে উপেক্ষিত। প্রতিদিন যে-সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে তার কয়েক গুণ সমাগম ঘটে। শুধু চিকিৎসা দেয়ার ওপরই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে না। ভর্তি রোগী দুদিন ধরে নিখোঁজ, বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও থানাকে অবহিত করা জরুরি ছিল।
হাসপাতালে কেউ ভর্তি হলে সেই রোগীর সব দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে দুটি অংশ রয়েছে, একটি হলো চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা এবং অন্যটি চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা। সার্বিক দায়িত্বে পরিচালক থাকেন। রোগী শয্যায় নেই, বিষয়টি কর্তব্যরত চিকিৎসক ও তার দল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। দুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে এখানে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। আর লিফটে ত্রুটি থাকলে সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। চিকিৎসা নিতে এসে এমন অপমৃত্যু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ভঙ্গুর দশার চিত্র তুলে ধরছে।’
হাসপাতালের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হকের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে গত রোববার তার কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এক কর্মচারীকে দিয়ে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আবু নোমান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। যোগাযোগ করা হলে ডা. রাব্বানী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তদন্ত হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদনও জামা দিয়েছে। তবে আমি তদন্ত কমিটিতে ছিলাম না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও অধিদপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনার পর পরই তদন্ত করে প্রতিবেদন মহাপরিচালকের কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল তা এত সময় পরে এসে মনে রাখা কঠিন।’