লোকালয়ে রিসাস বানর: মানবদেহে জুনোটিক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে

প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া রোগকে বলা হয় জুনোটিক ডিজিজেস বা জুনোটিক রোগ। প্রতিনিয়ত বন উজাড়, নতুন নতুন ভবন ও রাস্তা নির্মাণ, কৃষিজমি দখল, জলাভূমির পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের ফলে দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটছে। এতে খাদ্য ও আবাসস্থলের সংকটে পড়ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। কখনো কখনো খাদ্য ও নিরাপদ আবাসের সন্ধানে লোকালয়েও চলে আসছে তারা। তারপর মানুষের মুখোমুখি পড়লে আক্রমণ করে বসছে মানুষকেই। আক্রমণের ফলে প্রাণীদেহ থেকে শরীরে জীবাণু প্রবেশ করায় বিভিন্ন জুনোটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে মানুষ।

আবাসস্থলের সংকটে বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় রিসাস ম্যাকাক (এক ধরনের লালমুখী বানর) লোকালয়ে এসে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে মানুষের। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এ বানরের আক্রমণে দেশের মানুষের মধ্যে জুনোটিক রোগের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, প্রাণীর সঙ্গে বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে যেকোনো ধরনের যোগাযোগের সময়ে করা আক্রমণের ফলে এ রোগ ছড়াতে পারে। প্রাণী কখনো কখনো ক্ষতিকারক জীবাণু বহন করতে পারে, যা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে অসুস্থতার কারণ হয়। জুনোটিক রোগগুলো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী ও ছত্রাকের মতো ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা তৈরি হয়। এ জীবাণুগুলো মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার কারণ হতে পারে। তাতে মৃদু থেকে গুরুতর অসুস্থতা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। যেকোনো মেরুদণ্ডী প্রাণী মানুষের শরীরে এ রোগ ছড়াতে সক্ষম। মানুষের প্রতি ১০টি পরিচিত সংক্রামক রোগের মধ্যে ছয়টির বেশি প্রাণী থেকে ছড়াতে পারে। আর মানুষের মধ্যে প্রতি চারটি নতুন বা উদীয়মান সংক্রামক রোগের মধ্যে তিনটি আসে প্রাণীদেহ থেকে। দেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো জুনোটিক রোগ শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, নিপাহ, সোয়াইন ফ্লু, অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, এইচআইভি ও সর্বশেষ কভিড-১৯ রয়েছে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের পাবমেড জার্নালে প্রকাশিত ‘এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জ অ্যান্ড জুনোটিক ডিজিজেস রিস্ক অ্যাট হিউম্যান-ম্যাকাক ইন্টারফেস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই গবেষণাটি চাঁদপুর, মাদারীপুর ও পুরান ঢাকায় পরিচালিত হয়। এর মধ্যে পুরান ঢাকা ও মাদারীপুরের চরমুগুরিয়ায় রিসাস ম্যাকাকের সংখ্যা বেশি এবং মেঘনা নদীর তীরবর্তী চাঁদপুরের পুরান বাজারেও রিসাস ম্যাকাক রয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) থেকে গবেষণা প্রটোকল অনুমোদন নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার দুটি গবেষণা সংস্থা ও বাংলাদেশের আইইডিসিআরের ১৪ জন গবেষক।

গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণা এলাকার মধ্যে চাঁদপুরে নগরায়ণের সম্প্রসারণ ও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে ৭০ শতাংশ, মাদারীপুরে ৮৯ শতাংশ ও পুরান ঢাকায় ১০০ শতাংশ। প্রাকৃতিক পানির উৎস কমেছে চাঁদপুরে ৫৫ শতাংশ, মাদারীপুরে ৫৩ শতাংশ ও পুরান ঢাকায় ৫৮ শতাংশ। আর বনায়ন ধ্বংস করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি মাদারীপুরে ৮৪ শতাংশ। পুরান ঢাকায় ধ্বংস হয়েছে ৬৩ শতাংশ ও চাঁদপুরে ৪০ শতাংশ।

গবেষণার তিনটি এলাকাতেই ম্যাকাকগুলো লোকালয়ে এসে খাদ্যের সংস্থান ও আবাসস্থল খুঁজতে মানুষের খাদ্য ও পানি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে মানুষ ও বানরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। একই সঙ্গে প্রাণীদেহ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন জুনোটিক রোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বনভূমি হারিয়ে যাওয়ায় বাড়ির ফলের গাছের ওপর বানরের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। মানুষ অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের জন্য নদী ও পুকুর ভরাট করছে। তাতে পানির উৎসও হারাচ্ছে রিসাস ম্যাকাক। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিলুপ্তপ্রায় বানরগুলো লোকালয়ে আসছে। আর তাতে বাড়ছে মানুষের ওপর বানরের কামড় ও আঁচড়ের ঘটনা। বানরের আক্রমণের শিকার হওয়ার পর চিকিৎসার বিষয়ে মানুষের মধ্যে উদাসীনতাও দেখা গেছে।

যেকোনো বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের সংকট সবচেয়ে বড় সমস্যা উল্লেখ করে বন অধিদপ্তর পরিচালিত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও আবাসস্থল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মোল্ল্যা রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের খুব কম অঞ্চলেই রিসাস ম্যাকাক রয়েছে। লাল মুখ হলেও রিসাস ম্যাকাককে সরাসরি লালমুখো বানর বলা যায় না। এর চেয়েও লালমুখো বানর বাংলাদেশে রয়েছে। বন বিভাগের খাবারের ওপর নির্ভরশীলতার পাশাপাশি রিসাস বানর লোকালয় থেকেও খাবার খায়। ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট, পুরান ঢাকা ও বিমানবন্দর এলাকায় এ বানরকে খাবার দেয়া হচ্ছে।

গবেষণায় বলা হয়, সবচেয়ে বেশি এসব বানরের কামড়ের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুরে। এখানে বানরের মুখোমুখি হওয়া মানুষের ৮৯ শতাংশ কামড়ের শিকার হয়েছে। চাঁদপুরে ৫০ শতাংশ ও পুরান ঢাকায় ৫৮ শতাংশ মানুষ বানরের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছে। আর আঁচড়ের শিকার হয়েছে পুরান ঢাকার ৪২ শতাংশ, মাদারীপুরের ৩৭ শতাংশ ও চাঁদপুরের ১৫ শতাংশ মানুষ। লোকালয়ে এসে পড়ায় মানুষের ধাওয়াও খেয়েছে রিসাস ম্যাকাক। এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে বানরগুলো।

বন্যপ্রাণীর আক্রমণের ফলে প্রায় ৬০ ধরনের জুনোটিক রোগ হয়ে থাকে উল্লেখ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রাণী স্বাস্থ্য) ডা. মো. শাহিনুর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এ রোগগুলো সব যে বানরের মাধ্যমে ছড়ায় তা বলা মুশকিল। জুনোটিক ডিজিজের কিছু ভাইরাস রয়েছে যেমন র্যাবিশ। কুকুর, বিড়াল বা বানরের কামড়ে তা হতে পারে। প্রাণী ভাইরাসে আক্রান্ত না হলে এ রোগ ছড়ায় না। কিন্তু আমরা তো আর জানি না ওই প্রাণীর শরীরে কোনো ভাইরাস আছে কিনা, তাই যেকোনো বন্যপ্রাণীতেই ঝুঁকি রয়েছে। বানরের শরীরে যে ধরনের রোগ প্রতিরোধ বা জীবাণু থাকে তা মানুষের শরীরে থাকে না। তাই বানরের খাওয়া খাবার মানুষ খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও তথ্যবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, আগে বাংলাদেশের লোকালয়ে বানরের আধিপত্য দেখা যায়নি। সম্প্রতি আবাসস্থল ও খাদ্য সংকটের কারণে তারা লোকালয়ে আসছে। কিছু রোগ আছে যা বানরের হবে আবার মানুষের হবে না। আবার যেসব রোগ মানুষের হবে তা বানরের মধ্যে দেখা যাবে না। তবে এখন কিছু রোগের দেখা মেলে যা কখনই মানুষের শরীরে ছিল না। এগুলো প্রাণীর শরীর থেকেই আসছে। মানুষ জীবনধারণকে সহজ করার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতার ঝুঁকি তৈরি করছে। জুনোটিক রোগের বিষয়ে আমাদের প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে চিকিৎসার বিশাল কর্মযজ্ঞের খরচ থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত একটি নির্দিষ্ট জুনোটিক রোগ নিয়ে কাজ করি। জলাতঙ্ক নিয়ে কাজ করি আমরা। পরবর্তী সময়ে আমাদের কার্যক্রমে আরো রোগ যুক্ত হলে জুনোটিক ডিজিজেসের পরিধি বাড়াব। কোনো সন্দেহভাজন প্রাণীর আঁচড় বা কামড়ের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা প্রায় একই ধরনের। তবে মূল বিষয় হলো, বন্যপ্রাণীর আক্রমণের পর সবাই আমাদের কাছে আসে না।

Source: Bonik Barta

Share the Post: