শব্দদূষণে শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে ৬৪% ট্রাফিক পুলিশ

শব্দদূষণে শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে ৬৪% ট্রাফিক পুলিশ

রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে পাঁচ বছর ধরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ সদস্য ইদ্রিস আলী (ছদ্মনাম)। যানজট নিরসনে লম্বা সময়জুড়ে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে এখন শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন এ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য।

একই সমস্যার কথা জানালেন তার আরেক সহকর্মীও। তিনি বলেন, অধিক শব্দে কাজ করায় আমরা অসহনীয় সমস্যায় রয়েছি। রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়। মনমেজাজ ভালো থাকে না। যানবাহনগুলো যদি অনর্থক হর্ন না বাজাত তাহলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না।

শুধু এ দুজন নন, শ্রবণ সমস্যাসহ নানা শারীরিক জটিলতা ও মানসিক সমস্যায় আছেন রাজধানীর অধিকাংশ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর ৬৪ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ সদস্যই শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে গবেষণাটি করেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজের চিকিৎসক ডা. আবির্ভাব নাহা। এ গবেষণার জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। ‘নয়েজ এক্সপোজার অ্যান্ড নয়েজ ইনডিউকেড হিয়ারিং লস অ্যামং দ্য ট্রাফিক পুলিশ ইন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।

গবেষক ডা. নাহা জানান, গবেষণায় প্রথমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম চারটি অঞ্চলের ২৮টি এলাকার শব্দের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পরে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ট্রাফিক পুলিশের চারটি বিভাগের রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা ১০০ সদস্যের কান পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, ৬৪ শতাংশেরই শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে ৪০ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ঘুমের মধ্যেও তারা শব্দের মাত্রা অনুভব করেন। ৫৬ শতাংশ কানে সার্বক্ষণিক বিদঘুটে শব্দ পান এবং ২৭ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন।

গবেষণার জন্য যেসব সড়ককে বেছে নেয়া হয়েছে তার প্রত্যেকটি এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ছিল ১১০ ডেসিবল। সর্বোচ্চ ১৩২ ডেসিবল ছিল কোনো কোনো এলাকায়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীর পূর্ব বিভাগে শব্দের মাত্রা ছিল ১২৫ ডেসিবল, যেখানে কর্মরত ৭২ শতাংশ পুলিশ সদস্যেরই শ্রবণ সমস্যা রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পশ্চিম বিভাগে শব্দের মাত্রা ছিল ১১২ ডেসিবল এবং সেখানকার ৫৬ শতাংশ পুলিশ সদস্যের শ্রবণ সমস্যা রয়েছে। এছাড়া শব্দের মাত্রা ঢাকা উত্তর বিভাগে ১২১ ডেসিবল ও দক্ষিণ বিভাগে ছিল ১১৯ ডেসিবল। এ দুই এলাকায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের ৬৪ শতাংশই শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন।

এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত সদস্যদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষ ৮০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। শব্দের মাত্রা এর বেশি হলে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলে শ্রবণশক্তিতে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম বিভাগের পেশাজীবী সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের (ওএসএইচএ) সুপারিশ অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৮৫ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবে না। তারা বলছে, এ শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবল হলে ২ ঘণ্টা, ১১০ ডেসিবল হলে ৩০ মিনিট ও ১১৫ ডেসিবল হলে মাত্র ১৫ মিনিট কাজ করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) বলছে, ১১৫ ডেসিবলে ২৮ সেকেন্ড, ১১০ ডেসিবলে ৩০ সেকেন্ড, ১০৫ ডেসিবলে ৪ মিনিট, ১০০ ডেসিবলে ১৫ মিনিট, ৯৫ ডেসিবলে ৪৭ মিনিট, ৯০ ডেসিবলে আড়াই ঘণ্টা ও ৮৫ ডেসিবলে ৮ ঘণ্টা থাকা যায়। যদিও ঢাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার কোনো এলাকায়ই শব্দের মাত্রা ১১০ ডেসিবলের নিচে নয়।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যেহেতু সবসময় তীব্র শব্দের মধ্যে কাজ করেন, তাই তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা বেশি বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা সদস্যদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক, কান ও গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুসনে কমর ওসমানী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে শব্দদূষণ নানা কারণে হয়। এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হয়। তবে দিন দিন এ শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে। এর জন্য জোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’

ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ঠিক রাখতে বা ক্ষতির মাত্রা কমাতে তাদের কাজের স্থান পরিবর্তন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে স্থানে শব্দ কম, সেসব স্থানে তাদের বদলি করতে হবে। অন্যথায় তাদের সমস্যা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাবে। কেননা চোখের মতোই কান একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাধারণত ৬০ বছরের বেশি বয়স হলে শ্রবণশক্তি লোপ পায়। আমি যখন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করি তখন দেখেছি ৩৫-৪০ বছরের মধ্যেই তারা শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন।

শব্দদূষণ থেকে ট্রাফিক পুলিশদের রক্ষা করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘তাদের ব্যবহারের জন্য এয়ার প্লাগ দেয়া যেতে পারে।’

দেশের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, শব্দের মানমাত্রা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবলের বেশি হতে পারবে না। যদিও রাজধানীতে শব্দের মাত্রা ডব্লিউএইচও ও আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) নির্দেশিত শব্দের মানমাত্রার তুলনায় অসহনীয় বেশি। ঢাকার প্রতিটি স্থানেই শব্দের মাত্রা শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ নির্দেশিত মানমাত্রা অতিক্রম করেছে বলে এক জরিপ প্রতিবেদনে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

Source: Bonik Barta

Share the Post: