শৈশবের প্রারম্ভেই মানুষের বিকাশ হয় সবচেয়ে দ্রুত। কৈশোরে আবারো নতুন পর্বের সূচনা। শৈশব-কৈশোরের এ সময়ের অতিসাধারণ শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিগুলো যথাযথ পরিচর্যার অভাবে পরবর্তী সময়ে বড় আকার ধারণ করে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫-১৭ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে।
বিশেষ যত্ন ভুক্তভোগী এসব শিশুকে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ছয় মাসের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেকের গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। আট বছরের মধ্যে বিকাশ হয় মস্তিষ্কের ৯০ শতাংশ। বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, সামাজিক যোগাযোগ—মস্তিষ্কের বিকাশে ভূমিকা রাখা এসব বিষয় শিশুর শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলো শিশুর ভবিষ্যতের প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। এসব নিয়েই বিকশিত হয় মস্তিষ্ক। বিকশিত হওয়ার পথে বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে শিশুদের নির্ভরতার অনেকটাই অভিভাবক ও শিক্ষকের ওপর। যদিও অভিভাবক বা শিক্ষকরা এক্ষেত্রে পুরোপুরি সচেতন নন।
বাংলাদেশের ৫-১৭ বছরের শিশু-কিশোররা অন্তত ১৪ ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ৫-১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশ অন্তত একটি শারীরিক বা মানসিক জটিলতায় ভুগছে। এর মধ্যে শারীরিক অক্ষমতা যেমন চোখে কম দেখা, শ্রবণ সমস্যা, হাঁটার সমস্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। একইভাবে মানসিক জটিলতার মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, যোগাযোগের অক্ষমতা, বন্ধু তৈরিতে সমস্যা, মনে রাখার সমস্যা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতাসহ নানা জটিলতা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব শারীরিক ও মানসিক জটিলতা (ফাংশনাল ডিফিকাল্টিস) মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে বেশি। প্রতিটি জটিলতার সঙ্গে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কযুক্ত। ভুক্তভোগীদের ১০ শতাংশ অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান আর অতিধনী পরিবারের সন্তান ৬ শতাংশ। বিভাগভিত্তিক অবস্থানে বরিশাল ও ময়মনসিংহের শিশু-কিশোররা শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এসব শিশু-কিশোরের ২১ শতাংশ বরিশাল ও ১৮ শতাংশ ময়মনসিংহের বাসিন্দা। মূলত মানসিক স্বাস্থ্যের বিরূপ প্রভাব রয়েছে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে। বিষণ্নতায় ভুগছে ৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার হার ৩ শতাংশ। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা রয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ২ শতাংশ। এছাড়া দৃষ্টি ও শ্রবণ সমস্যা, বন্ধু তৈরিতে অনীহা, যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারা, মনোযোগ ভঙ্গ হওয়া, চলাফেরায় সমস্যা, নিজের প্রতি যত্ন নেয়ার অক্ষমতা, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়ে অভ্যস্ত হতে না পারা, শিখন সমস্যা ও মনে রাখতে না পারার মতো শারীরিক ও মানসিক জটিলতা রয়েছে।
ইউনিসেফের তথ্য মতে, ৫-৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এসব সমস্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশই এসব সমস্যার কোনো না কোনোটিতে ভুগছে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের চেয়ে এটি ২ শতাংশ বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হারে প্রভাব ফেলছে এসব সমস্যা। স্বাভাবিকভাবেই ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কম দেখা গেছে। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে একই শ্রেণীতে অধ্যয়নের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক ভাগে ভাগ করে সংস্থাটি বলছে, প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে। অন্যদিকে এ দুই পর্যায়ে যথাক্রমে ১১ ও ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী একই শ্রেণীতে অধ্যয়নের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে।
শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের এ সংস্থাটি বলছে, জীবনের শুরুর দিকে উৎসাহ জোগানো ও শিক্ষাই তার পরিপূর্ণ বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। কথা বলা, পড়া, গান গাওয়া, ধাঁধার সমাধান ও অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলা শিশুর ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মনোযোগ দিয়ে শোনে, কথায় সাড়া দেয়, শব্দের অনুকরণ করে, প্রথম অর্থবোধক শব্দ বলে, বড়দের কাজ-কর্ম অনুকরণ করে, বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, সমস্যার সমাধান করে ও খেলাধুলা শুরু করে। তিন থেকে পাঁচ বছরে শিশুরা নতুন নতুন বিষয় শেখা উপভোগ করে, দ্রুত ভাষা রপ্ত করতে থাকে, কোনো বিষয়ে বেশি সময় মনোযোগ ধরে রাখার সক্ষমতা অর্জন করে ও নিজের মতো করে কিছু করতে চায়।
সংস্থাটির শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বলেন, মূলত স্বল্প, মধ্যম ও গুরুতর শারীরিক ও মানসিক জটিলতার কারণে শিশু ও কিশোররা শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছিল। তারা সাধারণ শিক্ষার মধ্যে আসতে পারছিল না। আমরা পরবর্তী সময়ে তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে কাজ করি। সেক্ষেত্রে প্রথমে দেখতে হয়েছে, কী কী প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমরা সেসব প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছি। এখন অন্তত স্বল্প, মধ্যম সমস্যাগ্রস্তরা সাধারণ শিক্ষার মধ্যে আসতে পারছে। তবে স্বল্প, মধ্যম ও গুরুতর সমস্যা কী কী এ নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। শিশুদের সমস্যাগুলোকে এভাবে ভাগ করা দুষ্কর।
তিনি বলেন, সমস্যাগ্রস্ত শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার মধ্যে আনার জন্য প্রথমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের সচেতনতার জন্য কাজ চলছে। আগে এমন কোনো শিশুই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আসতে পারত না। এখন আমরা সমস্যাগুলো জানি এবং সমাধানও খুঁজছি। আমরা সরকারের সঙ্গে সারা দেশে কাজ করছি। এছাড়া ইউনিসেফের নিজস্ব বিভিন্ন কর্মসূচিও চলমান রয়েছে।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, এর আগে বিভিন্ন পরিসরে শিশু ও কিশোরদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা হতো। কয়েক বছর ধরে শিশু ও কিশোরদের শিক্ষার যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা তুলে আনতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন সব সীমবদ্ধতা তুলে আনা হয়। যেসব শিশু ও কিশোর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে শিক্ষার বাইরে থাকত তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে আনাই লক্ষ্য ছিল।
শিখন দক্ষতার সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সম্পর্কিত উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধির কোনো একটি বিষয়ে ঘাটতি থাকলে তা শিখন দক্ষতায় প্রভাব ফেলে। আমরা এর আগে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিইনি। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কোনোভাবেই ঘাটতি রাখা যাবে না। শিশু বয়সের পর কৈশোরের বয়ঃসন্ধির বিষয়টি এখনো ততটা গুরুত্ব পায়নি। নীতিনির্ধারণ ও সামাজিক অবস্থান এখানে দায়ী। পাঠ্যক্রম, সামাজিক বন্ধন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। আমরা শ্রেণীকক্ষকে শিক্ষার্থীদের মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারিনি। শুধু বোঝা বাড়িয়েছি।
গবেষণার তথ্য বলছে, বয়ঃসন্ধিকালের ১০-১৯ বছর পর্যন্ত সময়কে শৈশব-পরবর্তী ক্রান্তিকাল হিসেবে ধরা হয়। এ সময়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তন, অপব্যবহার বা সহিংসতা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী রোগের ১৬ শতাংশই মানসিক ব্যাধির কারণে হয়ে থাকে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। শিশু-কিশোরদের মধ্যে সাধারণ মানসিক ব্যাধি (সিএমডি) বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বিষয়টি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি শিশু ও কিশোর। যাদের মধ্যে আত্মঘাতী ধারণা, পরিকল্পনার সঙ্গে আত্মঘাতী ধারণা, আত্মহত্যার চেষ্টা, উদ্বেগ, একাকিত্ব, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের অভাব ও তামাক, সিগারেট, অ্যালকোহল এবং গাঁজা গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়। লিঙ্গ, বয়স, নিম্ন অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত ফলাফল (একাডেমিক গ্রেড), অভিভাবকের শিক্ষা, পরিবারের সঙ্গে বসবাস ও অ্যালকোহল গ্রহণ কিশোরদের মানসিক ব্যাধির অন্যতম কারণ।
জনস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুদের সমস্যাগুলোকে তাদের মতো করে বুঝতে হবে। শুধু বড়দের মধ্যে স্নায়বিক সমস্যা প্রকাশ পায় ও মানসিক অবসাদ থাকে এমন ধারণা এখনো রয়েছে। পরিবেশগত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলো শিশুদের প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে উঠছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব সমস্যার কথা ইউনিসেফ বলেছে তা বংশগত, আঘাত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে হয়ে থাকে। এ বিষয়গুলো কখনো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। আমাদের ভুল ধারণা এখন রয়েছে যে এসব সমস্যা শুধু বড়দের মধ্যে হয়। কিন্তু এসব সমস্যা আপাতদৃষ্টিতে ছোট হলেও তাদের ভবিষ্যৎ জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। শুরু থেকেই ছোট ছোট মানসিক ও শারীরিক সমস্যা শনাক্ত করা গেলে পরবর্তী জীবন হুমকিতে পড়ে না। শিশু-কিশোরদের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের মানসিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নত করে সমাধানের ব্যবস্থা করতে না পারলে সমস্যা আরো বাড়বে বলে মনে করেন এ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
মানুষকেই মানুষের দরকার কিন্তু এখন মানুষের জায়গাটি প্রযুক্তি দখল করেছে উল্লেখ করে নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, শারীরিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা সহজেই শনাক্ত করা যায়। বিপরীতে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলায় থেকে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাগুলো আমরা যেমন আমলে নিয়ে থাকি, শিশু বা কিশোর বয়সীদের ক্ষেত্রে তা করা হয় না। শিশুরা আগের মতো বন্ধু তৈরি করতে পারছে না। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। প্রযুক্তির ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল সম্পর্ক বা যোগাযোগ রক্ষা বা তৈরি হওয়ার জন্য, কিন্তু তা না হয়ে বিচ্ছিন্নতা বেশি দেখা যাচ্ছে। শিশু বা কিশোররা প্রযুক্তিকে শুধু মনিটরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। ফলে সব স্তরেই একে অন্যের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা যাচ্ছে। শৈশব ও কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ এ সময়কে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত।