দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চিকিৎসাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানও বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু যথাযথ মান নিশ্চিত করা হচ্ছে না এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে। তাছাড়া রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষা উপযোগী নয়। নীতিমালা না মানা সত্ত্বেও এসব কলেজ পরিচালিত হচ্ছে বছরের পর বছর। আবার কিছু কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দিলেও প্রভাবশালীদের চাপে সিদ্ধান্তে অটল থাকছে না নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার গুলশানে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজে সরকার প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা উপযোগিতায় ঘাটতি পাওয়া যায়। ফলে চার বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়কে স্থগিতাদেশের আদেশ বহাল রাখার সুপারিশও করা হয়। কিন্তু মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ চাপে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সুপারিশ করে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর।
জানা যায়, ২০০৩ সালে সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজে ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য একাডেমিক কার্যক্রমের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে সরকার প্রণীত ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী, কলেজ ও হাসপাতালের অবকাঠামো ও শিক্ষা কার্যক্রমের ঘাটতি থাকায় ২০১৭ সালে ভর্তি কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে পূর্ব নোটিস না দিয়ে এমন স্থগিতাদেশ দেয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত। ফলে পরবর্তী সময়ে ঘাটতি সংশোধন না করে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে থাকে কলেজটি।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন কমিটি ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে বেশ কয়েকবার প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে। ২০২১ সালের ২৩ মে পরিদর্শনে যে তথ্য পায়, তাতে কলেজের স্থগিতাদেশ বহাল রাখার জন্য মতামত দেয় কমিটি। এ সুপারিশ গত বছরের ৩ জুন মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে পাঠায় স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর। তবে মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ পুনর্বিবেচনার জন্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়। পরে কমিটির সদস্যদের মধ্যে রদবদল করে ২৭ জুন আবারো পরিদর্শন করা হয়। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে সরেজমিনে গিয়ে কমিটি প্রায় একই ঘাটতি শনাক্ত করে। এর পরও শিক্ষার্থী ভর্তির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ চাপেই এক মাসের ব্যবধানে আবার কলেজটি পরিদর্শন করা হয় ও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়।
গত বছরের জুনে পরিদর্শন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ভবনের জমি কলেজের নামে নিবন্ধিত নয়। নীতিমালা অনুযায়ী কলেজ ও হাসপাতালের জন্য এক একর করে দুই একর জমি প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ১৬৮ শতাংশ জমির ঘাটতি রয়েছে। ৯০ জন শিক্ষার্থীর জন্য কলেজ ও হাসপাতালের আলাদা ভবনে ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস করে ৩ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস থাকার কথা। তবে ঘাটতি রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অধিভুক্তির নবায়ন রয়েছে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত।
হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০ দাবি করা হলেও মে মাসের পরিদর্শনে ২০০ কেবিন বাদে ২৫০ শয্যা পাওয়া যায়। জুনে পাওয়া যায় ৩৫০ শয্যা। এর পরও ১০০ শয্যার ঘাটতির কথা জানিয়েছে কমিটি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যায় রোগী ভর্তির হার ৭০ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ২০ শতাংশ ভর্তি কম রয়েছে। বিভাগগুলোর মধ্যে বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজি ও গাইনি বিভাগে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। যেসব শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন, তাদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে কমিটি।
এসব ঘাটতি উল্লেখ করে মে মাসের প্রতিবেদনে ছয় মাসের মধ্যে গাজীপুরে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে ক্রয়কৃত ৭৩ শতাংশ জমির ওপর ভবন স্থাপন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার শর্তে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার সুপারিশ করে কমিটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্যক্রম শুরু না করলে কলেজের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলা হয়। তবে এক মাসের ব্যবধানে জুনে কলেজটি পরিদর্শন করলে প্রায় একই ধরনের ঘাটতি দেখা যায়। গাজীপুরে ক্যাম্পাস স্থানান্তরের সময়সীমা বাড়িয়ে এক বছর করা হয়। শিক্ষার্থী ভর্তিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও বর্তমান ভিত্তির ওপর এমবিবিএস কোর্সে ৯০টি আসনের জায়গায় ৭০টি আসনে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সুপারিশ করে পরিদর্শন কমিটি।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে স্থগিতাদেশ দেয় মন্ত্রণালয়। সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা রিট আবেদনে মন্ত্রণালয়ের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ পায় কলেজ কর্তৃপক্ষ। আদালতের আদেশ দেখিয়ে গত তিন শিক্ষাবর্ষে তারা ২২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ২০১৯ সালে সমাপনী বর্ষে পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ৭৫ শতাংশের কম। ঘাটতি পূরণে কলেজ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ না থাকায় বিভিন্ন সময়ের পরিদর্শনে কলেজের বিষয়ে নেতিবাচক মতামত দেয় কমিটি। মে মাসের পরিদর্শনের সুপারিশ বিবেচনার জন্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। পরে এক মাসের ব্যবধানে পরিদর্শন সাপেক্ষে বদলানো হয় সুপারিশ।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও ৩ নভেম্বর একাডেমিক কার্যক্রম অনুমোদন নবায়নের চিঠি দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে সর্বশেষ পরিদর্শন কমিটির সুপারিশে গাজীপুরের জমিতে এক বছরের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করে কার্যক্রম শুরুর শর্ত দেয়া হলেও মন্ত্রণালয় তা বাড়িয়ে দুই বছর করে। একইভাবে সুপারিশে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত অনুমোদনের কথা বলা হলেও মন্ত্রণালয় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন নবায়ন করে।
কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় বলছে, ঘাটতিগুলো দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে পাঁচটি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী এমবিবিএস অধ্যয়ন করছেন। তাদের মধ্যে শতাধিক বিদেশী শিক্ষার্থী রয়েছেন। ঘাটতির সমাধান ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের ঘাটতিগুলো আমরা দ্রুত সমাধানে চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে অনেক সমাধান করা হয়েছে। এখন শিক্ষকস্বল্পতা নেই, বেতন বকেয়া নেই। বিএমডিসির অধিভুক্তির নবায়নও করা হয়েছে।
সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাবউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেকের নিজস্ব ভবন পর্যন্ত নেই। দুই দশক ধরে আমরা সীমাবদ্ধতা একটু একটু করে সমাধান করছি। গুলশানে চাইলেও আর জায়গা বাড়ানো যাবে না। এজন্য আমরা গাজীপুরে নিজস্ব জমিতে ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। সীমাবদ্ধতাগুলো সমাধানে সময় প্রয়োজন। যখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন ঘাটতিগুলো দেখেই অনুমোদন দেয়া হয়। এখানে আমাদের অনিয়ম করার কিছু নেই। হঠাৎ করে আয় করতে না দিলে ব্যয় করা যায় না। আমরা চাইলেই কিন্তু কলেজ ছেড়ে দিতে পারি না। তাহলে শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে? এত মানুষ এখানে চাকরি করে তারা কোথায় যাবে? আমরা চেষ্টা করছি।
এক মাসের ব্যবধানে প্রায় একই সমস্যা থাকার পরও কেন সুপারিশ বদলানো হলো এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পরিদর্শন বা সুপারিশ করা হয়। মেডিকেল কলেজটিকে আবারো সময় দেয়া হয়েছে, তারা দ্রুত সমস্যার সমাধান করবে।
স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে কলেজের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা আমি যোগদানের আগে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।