শিক্ষিতদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বেশি

প্রতি বছর বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চ আয়ের দেশের চেয়ে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে এর বিস্তার বেশি। নিয়ন্ত্রণযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি এ রোগের ফলে অকালমৃত্যুর হারও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে মোট মৃত্যুর নবম কারণ অসংক্রামক এ রোগটি। বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের হার বেশি।

বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত গবেষক এ গবেষণা কাজটি পরিচালনা করেন। সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) একটি জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী সাড়ে ১৪ হাজার মানুষের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬ হাজার ৬৯১ জন নারী ও ৮ হাজার ১৩ জন পুরুষ। রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের ডায়াবেটিস পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করা হয়।

ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ১৩ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের ৬২ শতাংশই রোগটি নিয়ে সচেতন নয়। আর মাত্র ৩৫ শতাংশ নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে আবার উচ্চশিক্ষিত মানুষের হার সবচেয়ে বেশি। গবেষণার জন্য বাছাইকৃতদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করা হয়। সে অনুযায়ী দেখা গেছে, যাদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার ৯ দশমিক ৪৫, প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিতদের মধ্যে ৯ দশমিক ৭৭, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন এমন মানুষদের মধ্যে এ হার ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। এছাড়া উচ্চশিক্ষিতদের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত।

তিন কারণে শিক্ষিতদের মধ্যে ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের সমন্বয়ক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কায়িক পরিশ্রমের মাত্রা কম, তাদের খাদ্যাভ্যাস ডায়াবেটিস হওয়ার অনুকূলে ও তাদের মধ্যে মানসিক চাপ বা বিষণ্নতার মাত্রা বেশি। অনেক সময় বংশগত কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে শিক্ষিতদের মধ্যে ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পশ্চিমা দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পার্থক্য রয়েছে। সেসব দেশে শিক্ষিত ও ধনীরা অতি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কম গ্রহণ করে। অন্যদিকে আমাদের দেশে এ ধরনের খাদ্য গ্রহণের হার বেশি। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অতি দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। ফলে আমাদের বিনোদন, হাঁটার স্থানসহ নানা সামাজিক কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে আমাদের শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে, যার ফল হিসেবে বাড়ছে ডায়াবেটিসের হার।

এ বিষয়ে গবেষক দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন জানান, মূলত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য (বিডিএইচএস) জরিপে দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রবন্ধটি তৈরি করেছেন তারা। এটি এখন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পর্যালোচনার জন্য অপেক্ষমাণ। সরকারের জরিপ থেকে তথ্য নিয়ে ডায়াবেটিসের বিষয়ে পরিপূর্ণ এ গবেষণা প্রবন্ধটি তৈরির কথা জানান তিনি। এ শিক্ষক বলেন, আমরা এ জরিপের ফলাফলে প্রমিতকরণ (স্ট্যান্ডার্ডাইজড) করেছি। যেসব নমুনা জরিপের জন্য নেয়া হয়, অনেক সময় তাতে জাতীয় চিত্র উঠে আসে না। তাই প্রমিতকরণ করা হয়েছে।

তবে শুধু শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডায়াবেটিস বেশি তা একটি মাত্র জরিপের ভিত্তিতে নির্ণয় করা যায় না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ২০১৮ সালেও ডায়াবেটিস নিয়ে জরিপ করেছি। সব উপজেলার তথ্য তাতে নেয়া হয়েছিল। সেখানে গ্রামগঞ্জে বা শহরে সর্বস্তরে ডায়াবেটিস পাওয়া গেছে। কোথাও কম বা বেশি। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী টেবিলে বসে কাজ বেশি করে। তাদের মধ্যে হাঁটার প্রবণতা বা সুযোগ কম। কায়িক পরিশ্রম কম। একই সঙ্গে এ শ্রেণীর মানুষ ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি নির্ভরশীল বেশি। ছুটি বা অবসরেও তারা মুঠোফোন বা টেলিভিশনে সময় বেশি ব্যয় করেন। ফলে তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণগুলো বেশি। কিন্তু বংশগত কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে। আর তার সঙ্গে শিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের অবস্থা পর্যবেক্ষণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রমক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি একটি জরিপ চালিয়েছে। সেটির ফলাফল এখনো প্রকাশ না হলেও শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। দেশের ৪২৬টি উপজেলার এক লাখ মানুষের ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে ২০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। এ সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বলেও জানিয়েছেন গবেষণাসংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) জানিয়েছে, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের কোনো লক্ষণ থাকে না। বোঝাই যায় না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ফলে চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এতে ৪০ বছরের বেশি ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের দুটি ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। আগামীতে ইনসুলিনও দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডি কর্নারের (অসংক্রামক রোগী নিয়ন্ত্রণ কর্নার) ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১০০টিরও বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এরই মধ্যে এনসিডিসি কর্নার করা হয়েছে। কয়েকটি গবেষণার জন্য মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাবে, পৃথিবীতে যে পরিমাণ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তার মধ্যে ৭৯ শতাংশ নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। ধারণা করা হচ্ছে. ২০৪৫ সালের মধ্যে বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশেও দ্রুত হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৪ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা ২০৪৫ সালে দেড় কোটিতে দাঁড়াবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। প্রতি বছর ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে মৃতদের অর্ধেকই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ডায়াবেটিসের কারণে হূদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে অকালমৃত্যুর হার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডায়াবেটিস এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এ রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

প্রিভিলেন্স অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড প্রিডায়াবেটিস অ্যামং বাংলাদেশী অ্যাডাল্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত গবেষক। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিপোর্টের সর্বশেষ প্রকাশিত বিডিএইচএসের জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: