স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে পানিতে ডুবে বিপুলসংখ্যক শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে আখ্যা দিচ্ছে নীরব মহামারী হিসেবে। দেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে প্রাণ হারানোদের দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। বিষয়টি প্রতিরোধে পৌনে ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় সাড়ে তিন লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বরে। যদিও এখনো শিশুদের সাঁতার শেখানোর এ কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।
সরকারের তথ্য বলছে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ মোট ১৬ জেলার ৪৫ উপজেলায় এ প্রকল্প চলমান রয়েছে। স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের এনজিওর মাধ্যমে এসব উপজেলায় আট হাজার শিশু যত্ন কেন্দ্রে এটি বাস্তবায়ন করার কথা। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বহন করবে ২০ শতাংশ। প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফ বোট ইনস্টিটিউশন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কারিগরি পরামর্শকরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত প্রকল্পে দৃশ্যমান তেমন কিছুই হয়নি। প্রকল্পের বড় একটি উদ্দেশ্য ছিল ১ হাজার ৬০০টি নির্বাচিত স্থানে ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো। বাস্তবায়ন সহযোগী হিসেবে এনজিও নির্বাচনও করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দিতে দিতেই সময় পেরিয়ে গেছে। এখনো শুরু হয়নি পুকুর প্রস্তুত করে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কাজ।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, আগামী জুলাইয়ে সাঁতার শেখানো কার্যক্রম শুরু করা যাবে। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হতে পারে। তবে তাতে এতসংখ্যক শিশুকে সাঁতার শেখানো যাবে কিনা তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।
‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটিতে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী দুই লাখ শিশুর জন্য আট হাজার সমাজভিত্তিক শিশু যত্ন কেন্দ্র স্থাপন করার কথা। প্রতিটি কেন্দ্রে শিশু ভর্তি করা হবে ২৫ জন। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শিশুরা এসব কেন্দ্রে থাকবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন ১৬ হাজার গ্রামীণ নারী।
প্রকল্পের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক একেএম ফজলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্বাচিত এলাকাগুলোয় যেসব এনজিওর মাধ্যমে কাজ হবে সেগুলো বাছাই করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকবলকে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। তবে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। প্রশিক্ষকদের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। তবে প্রাক্কলিত সংখ্যক শিশুকে সাঁতার শেখানোর জন্য প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নের আগে প্রস্তুতির জন্য কত সময় লাগতে পারে তা আরো গুরুত্ব দিয়ে হিসাব করা উচিত ছিল। তবে গত দুই দশকে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে বেশকিছু কাজ করা হয়েছে। আমাদের গবেষণা সরকার বিভিন্ন সময় আমলে নিয়েছে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশের তৈরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বিশ্বের অনেক দেশ সরকারি পর্যায়ে কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু করতে পারেনি। সেখানে সরকার অন্তত একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নতুন কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা অস্বাভাবিক নয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৮৪ শতাংশ শিশু যত্ন কেন্দ্র পরিচালনায়, বৈদেশিক প্রশিক্ষণে দশমিক ১৮, সেমিনার-কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপে ১ দশমিক ৬২, অফিস ভবন ভাড়ায় দশমিক ৪৩, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে দশমিক শূন্য ৪, গবেষণায় ১ দশমিক ৭৯ ও পরামর্শক সেবা ক্রয়ে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে বছরে পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে ৩ লাখ ৭২ হাজার মানুষের। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ঘটছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। আর বাংলাদেশে পানিতে ডুবে বছরে মৃত্যু ঘটছে ১৯ হাজার। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ হাজার আঠারো বছরের কম বয়সী।
তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু শুধু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর চিত্রটি বেশ ভয়াবহ। এ অঞ্চলের শিশুরা পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। আর শহরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দিনে দুটি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। ডব্লিউএইচওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে পানিতে ডুবে মোট মৃত্যুর ৩৭ শতাংশ ঘটছে শূন্য থেকে চার বছর বয়সীদের। এছাড়া পানিতে ডুবে মৃতদের ২১ শতাংশ পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সী, ১৩ শতাংশ ১৫ থেকে ২৯ বছর, ১০ শতাংশ ৩০ থেকে ৪৯ বছর, ৬ শতাংশ ৫০ থেকে ৫৯ বছর, ৫ শতাংশ ৬০ থেকে ৬৯ বছর ও ৯ শতাংশ সত্তোরোর্ধ্ব বয়সী। আবার মোট মৃতের ৬৮ শতাংশ পুরুষ আর নারী ৩২ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাস্তবিক অর্থে মৃত্যু ঠেকাতে যে প্রকল্পগুলো নেয়া হয় সেখানে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এখানে সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থার আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যে-সংখ্যক শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা তাদের যথাসময়ে শেখানো গেলে দেখা যেত, তাদের মধ্যে কেউ ডুবে মারা যাচ্ছে কিনা। সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেত। প্রকল্পের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে মুখ্য হলো সাঁতার শেখানো। শুরুতে প্রকল্পের কর্মকৌশল করার সময় আন্তরিকতার অভাব ছিল। কীভাবে কাজ হবে, কত সময় প্রস্তুতিতে লাগবে এগুলোর কৌশলে হয়তো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে শেষ পর্যায়ে এসেও কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।’
তার মতে, শহরাঞ্চলের শিশুরা গ্রামে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। শহরের শিশুরা কেউ কেউ সুইমিং পুলে সাঁতার শিখলেও নদী বা খালের স্রোতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে তারা গ্রামে গিয়ে নদীতে বা খালের স্রোতে পড়ে গেলে সেই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারছে না। জীবন বাঁচানোর জন্য যতটুকু স্থিরতা, সক্ষমতা ও সাহস দরকার তা শহরের শিশুদের অনেক ক্ষেত্রেই নেই।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জনস্বাস্থ্যমূলক গবেষণা ও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কারিগরি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে সিআইপিআরবি। সংস্থাটির আরেক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে। আর সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে পানিতে ডুবে ঘটা প্রতি তিনটি মৃত্যুর মধ্যে দুটির শিকার হয় শিশুরা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে সরকার শিশুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে সরকার পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে শিশু যত্ন, সুরক্ষা ও সাঁতার শেখানোর জন্য কমিউনিটিভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প শুরু করেছে সরকার।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান। আনুষঙ্গিক প্রশিক্ষণগুলো শেষ হয়েছে। কারা কারা এখানে কাজ করবেন তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কাজ প্রায় শুরু হয়েছে।’
বিলম্বের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ কার্যক্রমগুলো বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে করা হয়। আর যারা কাজ করবেন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এসবের জন্য সময় লেগেছে। এখন কার্যক্রম শুরু করার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।’