সংস্থান হওয়া সাড়ে ৩১ কোটি টিকার ৩৩% উপহার-অনুদান

বাংলাদেশে গণপরিসরে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার প্রয়োগ শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। প্রথমে টিকার সংস্থান নিয়ে কিছুটা বিড়ম্ব্বনা সৃষ্টি হলেও এখন সরকারের কাছে পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা রয়েছে। আগামী এপ্রিলের মধ্যে সাড়ে ৩১ কোটি টিকার সংস্থান হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। চার ধরনের উৎস থেকে এসব টিকা পাওয়া যাচ্ছে। যার মধ্যে ৩৩ শতাংশই অনুদান ও উপহার হিসেবে পাচ্ছে সরকার। তবে টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি নিবন্ধনের সংখ্যা। এতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টিকাদানের লক্ষ্য পূরণ হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে এটিই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, কার্যক্রম শুরু থেকে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার ডোজ করোনার টিকার সংস্থান করেছে সরকার। চারটি উৎস থেকে পাওয়া এসব টিকার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে কেনা টিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ভারত ও চীন থেকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ৩৪ শতাংশ টিকা কেনা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে কেনা হয়েছে ৩৩ শতাংশ টিকা। পাশাপাশি এ জোট থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে ২৮ শতাংশ। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় উপহার হিসেবে ৫ শতাংশ টিকার সংস্থান হয়েছে।

চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য আটটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ও মডার্নার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত এসব টিকার মোট সাড়ে ৩১ লাখ ডোজ নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে বলে দাবি করছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংস্থান হওয়া টিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে চীনের সিনোফার্ম। মোট ৩৬ শতাংশ টিকাই সিনোফার্মের। এরপর ২৫ শতাংশ সিনোভ্যাকের, ২০ শতাংশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার, ১৪ শতাংশ ফাইজার-বায়োএনটেকের ও ৫ শতাংশ মডার্নার টিকা।

বিভিন্ন ছোটখাটো উৎসের পাশাপাশি চারটি নিশ্চিত উৎস থেকে ভবিষ্যতেও টিকার সংস্থান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক কর্মকর্তা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এখন পাঁচটি টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব টিকা নিয়মিতভাবে দেশে আসছে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। মূলত যেসব উৎস থেকে নিশ্চিত টিকা পাওয়া যাবে, সেগুলোই হিসাব করা হয়েছে। ফলে এর ব্যত্যয় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনতে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। সে হিসেবে ১৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। প্রতিজনকে দুই ডোজ টিকা দিতে হলে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োজন। তবে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের জন্য আরো টিকার প্রয়োজন পড়বে। সংস্থান হওয়া টিকা সঠিক সময়ে পাওয়া গেলে সংকট সৃষ্টি হবে না বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেনা টিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার ১৬ কোটি ৮০ লাখ করোনার টিকা পেয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। যার মধ্যে ১১ কোটি ২৫ লাখ ৬৬ হাজার টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। যেখানে ৬ কোটি ৭৮ লাখ প্রথম ও ৪ কোটি ৪৭ লাখ দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারের কাছে পাঁচ কোটি ডোজের বেশি টিকা মজুদ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার কোটি টাকার টিকা কিনেছে সরকার।

অন্যদিকে গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হয়। এটি কম সময়ে দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হওয়ায় বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছে ডব্লিউএইচও। বাংলাদেশসহ অন্তত ৬০টি দেশে ধরনটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের ক্ষতির মাত্রা কম হলেও যেহেতু এটি দ্রুত ছড়ায় তাই হঠাৎ করেই সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে টিকার বুস্টার ডোজ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ দুই ডোজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু হবে। তৃতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু হলেও টিকার কোনো সংকট হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত এ জনগোষ্ঠীর ২৭ শতাংশ পেয়েছেন দুই ডোজ টিকা। নিবন্ধনকৃতদের ৮৬ শতাংশকে প্রথম ডোজ ও ৫১ শতাংশকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে। আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্ধারিত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। টিকার যে সংস্থান সরকার করেছে, তাতে জোগানে সংকট দেখা দেবে না। কিন্তু যেহেতু নিবন্ধনের হার কমে গেছে, ফলে টিকা প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর সেটি হলে লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্থানের কথা বলা হলেও বাস্তবতা হলো সব টিকা এখনো দেশে আসেনি। যে পরিমাণ টিকা হাতে আছে তা নিয়েই পরিকল্পনা করা উচিত। এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশের কম মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এপ্রিলের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষকে দিতে হলে কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষমাণদের দ্রুততার সঙ্গে টিকা দিতে হবে। যারা দুটি ডোজ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, যারা বয়স্ক, ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর সদস্য তাদের দ্রুত বুস্টার ডোজ দিতে হবে।

টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়লেও নিবন্ধনের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কর্মপরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, শুরুতে যে হারে নিবন্ধন হয়েছিল, তা অব্যাহত নেই। নিবন্ধনের হার কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে না পারলে সরকার টিকা কার্যক্রমে সফল হবে না। ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনসহ জেলা-উপজেলায় টিকা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। টিকায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি। এ সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে হবে। তা না হলে নিবন্ধনের সংখ্যা বা টিকা প্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়বে না।

সাধারণ মানুষ যেন টিকা গ্রহণ করতে আগ্রহী হন, সেজন্য কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, টিকা প্রয়োগের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষকেও নিবন্ধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে চাই। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করছি। নিবন্ধন কম হওয়ায় উদ্বেগের কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ কর্মকর্তা বলেন, এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। কখনো নিবন্ধন বেশি হবে, আবার কখনো কম। এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যথাসময়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বিষয়ে আশাবাদও প্রকাশ করেন তিনি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: