সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর বজ্রাঘাতে নয় কৃষকের মৃত্যু হয়। তারা সবাই ওইদিন দুপুরে জমিতে কাজ করছিলেন। ২০১৮ সালের ১ মে সুনামগঞ্জ সদরে সকালের দিকে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন আব্দুর রশিদ ও কমলা কান্ত তালুকদার নামে দুজন। বিভিন্ন তথ্য-বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০০ জনের মৃত্যু হয় বজ্রাঘাতে। এর মধ্যে সকাল ও দুপুরে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দিনের ওই দুই সময়ে মৃত্যুহার বেশি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় ৫ হাজার ৬০০ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ আড়াই হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে। আমেরিকান মেট্রোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত ‘লাইটনিং ফ্যাটালিটিস ইন বাংলাদেশ ফ্রম ১৯৯০ থ্রু ২০১৬’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, ২৬ বছরে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ৩ হাজার ৮৬ জনের মধ্যে ৯৩ শতাংশই গ্রামের বাসিন্দা। তারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত। আর প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে বছরে মৃত্যু হয়েছে প্রায় একজনের। তবে ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুজনে। মূলত বর্ষার শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি (৬২ শতাংশ) বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়। এছাড়া বর্ষার মধ্যবর্তী সময়ে ৩৩, বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে ৪ দশমিক ৫ ও শীতকালে মৃত্যু হয় ১ দশমিক ৫ শতাংশের। গবেষণায় আরো ওঠে এসেছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে দিনের সকাল ও দুপুরের বজ্রঘাতে। কেননা এ সময়ে শ্রমিক ও কৃষকরা মাঠে-ঘাটে কাজে ব্যস্ত থাকেন।
গবেষণা বলছে, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাকে ছয় ভাগে ভাগ করলে মোট মৃত্যুর ৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয় রাত ১২টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত, ভোর ৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ৯ দশমিক ২৬, সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৩০, দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৮৫, বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১৯ ও রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে সকাল ১০টার দিকে যে বজ্রপাত হয়েছে তাতে প্রাণক্ষয়ের হারটা সবচেয়ে বেশি। প্রায় আড়াই দশকে ওই সময়ে মারা গিয়েছেন ১৫০ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে বেলা ২টার সময় ১৪৫ জন। সবচেয়ে কম মারা গেছেন ভোর ৪টার বজ্রাঘাতে। গেল ২৬ বছরে কেবল দুজনের মৃত্যু হয়েছে এ সময়ে। এদিকে বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ শতাংশই কৃষিজীবী। আকস্মিক এ দুর্যোগের সময় দ্রুত সরে যাওয়ার নিরাপদ স্থান না থাকার কারণে কৃষি ক্ষেতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশের বজ্রাঘাত নিয়ে গবেষণাটি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চার গবেষক। তাদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আবহাওয়াজনিত কারণে সকালে ও দুপুরের বজ্রাঘাতে মৃত্যুর হার বেশি। দিন শুরুর পর সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। যেসব কারণে বজ্রাঘাত হয় তা এ সময়ের জন্য উপযোগী। এ সময় মানুষজন কাজের জন্য ঘরের বাইরে থাকে।’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে বর্ষা-পূর্ববতী মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাসে উষ্ণ বায়ুর কারণে ভূপৃষ্ঠের পানি বাষ্প হয়ে মেঘের নিচের ভারী অংশের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। ফলে জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক চার্জে পরিণত হয়। আবার কিছু জলকণা ওই ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়। মেঘের মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জগুলো থাকে। একটি মেঘের ধনাত্মক চার্জের সঙ্গে অন্য মেঘের ঋণাত্মক চার্জের সংঘর্ষ হলে জলীয়বাষ্প মেঘে পরিণত হয়ে বিদ্যুৎ উত্পন্ন করে। হালকা ধনাত্মক চার্জ মেঘের ওপরে অবস্থান করে আর ভারী ঋণাত্মক চার্জ থাকে নিচের দিকে। ভূমির চার্জের সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি দিন দিনই বাড়ছে। বিশ্বে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি বজ্রাঘাতের ঘটনা ঘটে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ঝড়, খরা, বন্যা ও বজ্রাঘাতপ্রবণ অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশে বজ্রাঘাতের ঘটনা তীব্র হয়েছে।
দিনের যে সময় সূর্যের আলো প্রখরভাবে ভূমিতে পড়ে ওই সময়টি বজ্রপাতের জন্য উপযোগী বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. তৌহিদা রশীদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দিন শুরুর পর সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এ সময় সূর্যের প্রখর কিরণটা ভূমিতে পড়ে, যা বজ্র তৈরিতে উপযোগী। তবে বিভিন্ন মৌসুমে বজ্রপাতের তারতম্য থাকে। অনেক সময় রাতের আবহাওয়া সকালে বজ্রপাত সৃষ্টিতে উপযোগী হতে পারে।’ তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যেকোনো দুর্যোগই বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। আর এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি বজ্রপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। জলোচ্ছ্বাস, আকস্মিক বন্যা ও হারিকেনের পর আবহাওয়া সংক্রান্ত কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে বজ্রাঘাতে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে এ দুর্যোগে মৃত্যুর হার বেশি। আর গ্রামীণ পর্যায়ে মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। এর মধ্যে কৃষিজীবীই বেশি। বাকিরা বাড়ির উঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায়, রাস্তায়, পানি সম্পর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে মারা গেছেন।
বজ্রাঘাতে আহতরাও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতে বেশির ভাগ আহতরা হূিপণ্ডের জটিলতায় ভোগেন, যা তাদের দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একাডেমিক উইংয়ের সাবেক প্রধান ডা. শাহ মাহফুজুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে বজ্রপাতে হতাহতদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বজ্রপাতে যারা আহত হচ্ছেন তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। যেমন হূদরোগ, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত, স্নায়বিক সমস্যা, পুড়ে যাওয়া, চোখের ক্ষতি, পেশির ক্ষতি। আর পেশির ক্ষতি হলে ইউরিনের সমস্যায় কিডনিতে প্রভাব পড়তে পারে, প্রজননস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ভয়ের কারণে ট্রমাক্রান্ত হতে পারে ভিকটিম।’
দেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত প্রবণ জেলা। ফলে এ ১৫ জেলায় মৃত্যুও বেশি। বজ্রপাত নিরোধের জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব জেলায় বজ্রপাত বেশি তা নিয়ে আমরা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পাইলটিং করেছি। এরই মধ্যে একটা প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে যেসব জেলায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে সেগুলোকে ডিপিপির আওতায় এনে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হবে।’