শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ভারী কাজ করতে পারতেন না নজরুল ইসলাম। চিকিৎসকের পরামর্শে হাঁটাচলাও কম করতেন। তাই জীবনের তাগিদে রাজধানীর বারিধারায় একটি বাড়িতে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি নেন। একদিন নিজের ওষুধ কিনে প্রগতি সরণির ব্যস্ত সড়ক পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শ্বাসকষ্ট ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারেও অক্ষম ছিলেন এ বৃদ্ধ। বিষয়টি উল্লেখ করে থানায় মামলা করেছে নিহতের পরিবার।
গাজীপুর থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন রিহাজুল ইসলাম। ফেরার পথে ৫ মে বিমানবন্দর সিভিল এভিয়েশনের নতুন ভবনের সামনে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়িচাপায় প্রাণ হারান। ডাক্তার দেখাতে এসে গতকাল খিলগাঁওয়ে পিকআপ ভ্যানের চাপায় নিহত হয়েছেন শরীয়তপুরের বৃদ্ধা মোছা. ফরিদা বানু।
চিকিৎসা নিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া কিংবা ফেরার পথে নজরুল, রিহাজুল ও ফরিদার মতো অনেকেই ঢাকার সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনার বেশির ভাগই ঘটছে শাহবাগ মোড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সামনে। ব্যস্ততম মহানগরীর সড়ক ব্যবস্থায় অসুস্থ ও পঙ্গুদের চলাচলের সুবিধা না থাকাকেই এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন এলাকাগুলো চলাচলের উপযোগী নয়। বিশেষ করে হাঁপানি, শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও হৃদরোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার কঠিন হয়ে পড়ে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হতে বাধ্য হন চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিরা। প্রগতি সরণিতে দুর্ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের ছেলে মিরাজ হোসাইন জানান, শারীরিক দুর্বলতার কারণে তার বাবা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারতেন না। সিঁড়ির কয়েক ধাপ ওঠার পরই হাঁপিয়ে উঠতেন। তাই বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতেন। সে কারণেই ৬ মে তিনি গাড়িচাপায় আহত হন। পরে হাসপাতালে মারা যান। অসুস্থদের জন্য রাস্তা পারাপারে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় নজরুলকে এভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে বলে মনে করেন তার ছেলে। এ ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে নিহতের পরিবার।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, শ্বসনতন্ত্রের মতো অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা বেশি হয়। আর এসব রোগে যারা আক্রান্ত তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগে। এ সময় নিয়মিত সঠিক চিকিৎসা ও যত্নের প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাই এসব বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) হাসপাতাল এলাকায় নিয়মিতই ভিড় লেগে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষায়িত পর্যায়ের একটি হাসপাতালে দৈনিক পাঁচ থেকে ১০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। তাদের সঙ্গে থাকে আরো ২০-৩০ হাজার স্বজন। অথচ দেশের হাসপাতাল এলাকায় চলাচলের পথগুলো রোগীদের জন্য উপযুক্ত নয়। ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার করা রোগীদের জন্য কঠিন। বিশেষ করে শারীরিক দুর্বলতা ও বিধিনিষেধ থাকায় হৃদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টের রোগীরা জটিল এ পথ অতিক্রম করতে পারে না। তাই হাসপাতাল এলাকায় যান চলাচল সীমিত এবং রোগীদের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা জরুরি বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে রোগী ব্যবস্থাপনা পরিপূর্ণভাবে নেই। যতটুকু রয়েছে তা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই। সেখানেও আবার ভিড় ব্যবস্থাপনা নেই। তবে হাসপাতাল এলাকার রোগীরা কীভাবে চলাচল করবে, তা নিয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয় জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলবে, কীভাবে রোগীদের সুবিধা হয় আর স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সড়ক বিভাগ সে অনুযায়ী হাসপাতাল এলাকার আশপাশের রাস্তা ও চলাচলের পথ তাদের জন্য উপযোগী করে তুলবে। দেশের হাসপাতালগুলোর আশপাশ এলাকা রোগীদের জন্য আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা এখন খুবই জরুরি। কেননা রোগীর চাপ বাড়ছে।’
এক রোগের চিকিৎসা নিতে এসে অন্য কোনো দুর্ঘটনার শিকার কেউ হোক তা কাম্য নয় জানিয়ে এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে ফ্লাইং চিকিৎসকের ধারণাটাও নেই। অর্থাৎ চিকিৎসক তার দল নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন, হাসপাতাল এলাকা বা অন্য কোথাও কোনো রোগী দুর্ঘটনার শিকার হলে তাৎক্ষণিক সেখানে পৌঁছে ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন।’
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শাহবাগ। চত্বরটির দুদিকে রয়েছে দুটি টারশিয়ারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান—বিএসএমএমইউ ও বারডেম। রাজধানীবাসী ছাড়াও তৃণমূলের মানুষ এখানে চিকিৎসার জন্য আসে। তবে রোগীদের চলাচলের জন্য উপযোগী ব্যবস্থাপনা নেই এ এলাকায়। প্রায়ই স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা এসব রোগীকে রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কেননা সেখানে নেই যথোপযুক্ত জেব্রা ক্রসিং। ট্রাফিক সিগন্যালের সময় রাস্তা পার হতে গেলেও পড়তে হয় ভারী যানবাহনের সামনে। এতে ছোট-বড় দুর্ঘটনারও শিকার হতে হয়।
এক তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা নিতে এসে গত এক বছরে হাসপাতালসংলগ্ন শাহবাগে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে অন্তত ১০ রোগী। একইভাবে আগারগাঁওয়ে রয়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটসহ বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। তাই রোগীর সমাগম বেশি। একই এলাকায় রয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বিভিন্ন দেশীয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রধান কার্যালয়। ফলে যান চলাচল ও জনসমাগমও স্বাভাবিকের চেয়ে থাকে বেশি। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।
রাজধানীর হাসপাতাল এলাকাগুলোয় অতিরিক্ত পথচারীর চাপ ও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার রোধে নিজেদের বেশকিছু পদক্ষেপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল এলাকাগুলোয় রোগী ও স্বজনদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ট্রাফিক বিভাগ সবসময়ই তৎপর থাকে। বিশেষ করে হাসপাতাল এলাকার অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করে পথচারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা হয়। এছাড়া হাসপাতাল এলাকাগুলোয় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি থাকে। যেমন ধরেন শাহবাগ মোড়ের একদিকে বিএসএমএমইউ, অন্যদিকে বারডেম। এ দুই হাসপাতাল মিলে রোগী ও স্বজনদের রাস্তা পারাপারের প্রবণতা বেশি থাকে। ফলে নানা ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। আবার উন্নয়নকাজের জন্য অনেক স্থানে ফুটওভার ব্রিজ সরিয়ে নেয়ায় সেখানেও তৈরি হয় রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি। এক্ষেত্রে রোগী ও স্বজনদের জেব্রা ক্রসিং অনুসরণ করতে হবে। অথবা সংশ্লিষ্ট স্থানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সহায়তা নিয়ে রাস্তা পার হতে হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে নগরায়ণের পরিসর বাড়লেও হয়নি আদর্শ পরিকল্পনা। একটি নগরের সড়ক ও চলাচলের সব বিষয় বাস্তবায়ন করতে হয় সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা বিবেচনা করে। সড়ক করা হলেও তাতে কতটুকু ফুটপাত থাকবে, পথচারীরা কীভাবে রাস্তা পার হবে তা বিবেচ্য। কেননা ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসই সমাধান নয়। সব বয়সের মানুষ এগুলো ব্যবহারে সক্ষম নয়। হাসপাতাল এলাকার সড়কগুলো রোগীবান্ধব হওয়া উচিত বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে ঢাকার নগর পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলো আমলেই নেয়া হয় না। হাসপাতালকেও আর আট-দশটা বিল্ডিংয়ের মতো বিবেচনা করা হয়। রোগীদের জন্য আলাদা কেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ধরে নেয়া হয় মানুষ ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করেই হাসপাতালে আসবে। অথচ দেখা যায় রোগীদের মধ্যে বৃদ্ধ আছে, শিশু আছে। তাছাড়া রোগী মানেই তো তার কিছু জটিলতা আছে। স্বাভাবিক চলাচল করতে পারছে না। তাই হাসপাতাল এলাকার সড়কগুলো রোগীবান্ধব হওয়া উচিত।’