সরকারি মেডিকেল কলেজ: অবকাঠামো ও জনবল সংকটেও আসন সংখ্যা বেড়েই চলেছে

শিক্ষকসহ সার্বিক জনবল সংকটে ভুগছে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো। রয়েছে তীব্র অবকাঠামো সংকট। নেই পর্যাপ্ত আধুনিক শিক্ষা উপকরণ ও ল্যাব সুবিধা। এর মধ্যেও বাড়ছে আসন সংখ্যা। দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি) কোর্সে আসন সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের কিছু কম। আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০২৩-২৪) আরো ১ হাজার ৩০টি আসন বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ। জনবল ও অবকাঠামো সংকট সমাধান না করে এক ধাক্কায় প্রায় ২৪ শতাংশ আসন বাড়ানোর এ ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষার জন্য যথাযথ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর সবক’টিতেই শিক্ষক সংকট। শিক্ষার্থীদের সর্বাধুনিক শিখন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ক্লাস, পরীক্ষাগার ও হাসপাতালে প্রশিক্ষিত করা অত্যাবশ্যক। সরকার গত দেড় দশকে ২০টি নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু কলেজগুলোয় সে অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণ বাড়ানো হয়নি। কোনো কোনো কলেজের নিজস্ব একাডেমিক ভবনই নেই। বেশ কয়েকটির নিজস্ব হাসপাতাল নেই। রয়েছে পরীক্ষাগার, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক ও দক্ষ অন্যান্য লোকবলের অভাবও। এসব সংকট সমাধান না করে কলেজগুলোর আসন সংখ্যা যত বাড়ানো হবে চিকিৎসা শিক্ষার মানও তত নিম্নগামী হবে। এর ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে হুমকিতে পড়তে পারে দেশের চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য খাত।

২০০৯ সালে দেশে এমবিবিএস কোর্সের আসন ছিল ২ হাজার ৫০টি। গত দেড় দশকে তা ক্রমেই বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহেই আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০২৩-২৪) আসন বাড়ানোর কথা জানিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ। ওই প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৩৫০। আগামী শিক্ষাবর্ষে তা আরো প্রায় ২৪ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৮০টি। সবগুলো কলেজেই নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আসন বাড়ানো হয়েছে। কলেজগুলোয় আসন বেড়েছে সর্বনিম্ন ২০টি থেকে সর্বোচ্চ ৫০টি পর্যন্ত।

প্রায় এক দশক আগে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ। বর্তমানে এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে ৫১টি আসনে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা বাড়িয়ে ৭৫টি করা হয়েছে। কলেজটির নিজস্ব একাডেমিক ভবন নেই। নিজস্ব হাসপাতালও নেই। স্থানীয় জেলা হাসপাতালের একটি ভবনে চলছে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিতে বর্ধিত আসনের শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষ সংকট দেখা দেবে বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. প্রীতি প্রসূন বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে নানামুখী সংকট রয়েছে। জেলা হাসপাতালের একটি ভবনে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে। আসন বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে একাডেমিক সক্ষমতা বাড়েনি। বেসিক সায়েন্সের শিক্ষকের সংকট রয়েছে।’

একইভাবে নানা সংকট থাকলেও পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের আসন ২৫টি বাড়িয়ে ৭৫টি করা হয়েছে। একই চিত্র রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোরও। প্রতিষ্ঠার আট বছর পরও মুগদা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব একাডেমিক ভবন গড়ে তোলা যায়নি। রয়েছে শিক্ষা উপকরণেরও সংকট। এ কলেজটিরও আসন বাড়ানো হয়েছে।

কলেজ ভবন ও নিজস্ব হাসপাতাল নেই পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের। জেলা হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। এ কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান শাহীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌খুব শিগগিরই অবকাঠামোর সংকট কেটে যাবে। শিক্ষক সংকট রয়েছে। তবে তা সমাধানের চেষ্টা চলছে।’

তথ্য অনুযায়ী, আগামী শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে বেশি আসন বাড়ানো হয়েছে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজে ৫০টি আসন বাড়িয়ে ১২৫টি করা হয়েছে। এরপর সর্বনিম্ন ২০টি করে আসন বেড়েছে ১৩টি মেডিকেল কলেজে। এসব কলেজে আসন বাড়ানোর ক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজের অবকাঠামো ও অন্যান্য সক্ষমতাকে আমলে নেয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২২টিতে নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে। বাকি ১৫টি কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল নেই। কলেজগুলো হলো পাবনা মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ বলছে, চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সময়ের প্রয়োজনে মেডিকেল কলেজগুলোয় আসন সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। বিগত ১০ বছরে দেশের এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে আসন সংখ্যা এবং মেডিকেল কলেজের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালে দেশে মোট মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ৫০। এর মধ্যে সরকারি ১৭টি, বেসরকারি ৩২ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি। বর্তমানে দেশে সরকারি ৩৭টি, বেসরকারি ৬৬ ও সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে।

মেডিকেল কলেজগুলোর আসন বৃদ্ধির সময় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের চিকিৎসা শিক্ষার মান এখন নিম্নগামী। কলেজগুলোয় আসন বাড়ানো হয়েছে কিন্তু শিক্ষক সংকট রয়ে গেছে। ১০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক প্রয়োজন। বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী রয়েছেন তাদের জন্যও পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। সেখানে আসন বাড়ানো অযৌক্তিক। প্রশিক্ষণের জন্য অনেক কলেজের হাসপাতাল নেই। প্রশিক্ষণ ছাড়া একজন কীভাবে চিকিৎসক হয়ে উঠবেন। গবেষণার জন্য গবেষণাগার, পরীক্ষাগার ও গ্রন্থাগার নেই। এসব না থাকলে চিকিৎসা শিক্ষার মান ব্যাহত হবেই।’

এভাবে শিক্ষার মান ব্যাহত হলে তা স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আরো দুর্বল করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের ক্যারিয়ারকেও হুমকিতে ঠেলে দেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‌বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেডিকেল কাউন্সিলকে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশন স্বীকৃতি দেয়। মেডিকেল কাউন্সিলের নীতিমালা থাকে যে কীভাবে কলেজগুলো চলবে। এর ব্যত্যয় হলে দেখা যায়, ওইসব কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জনকারী চিকিৎসকরা বিশ্বের কোথাও উচ্চশিক্ষা নিতে পারেন না। চাকরিও পান না। চিকিৎসা শিক্ষার মান বাড়াতে হবে।’

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের গাইডলাইনে একটি মেডিকেল কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অন্তত ১১টি বিষয়কে (বিভাগ) অত্যাবশ্যক বলা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, সার্জারি, মেডিসিন এবং গাইনি ও অবস। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস ও বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ডিগ্রি দেয়া হয়, সেগুলোর একটি সাধারণ নীতিমালা হলো প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে। যদিও সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষকের পদ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮টি, যার মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ২ হাজার ৫৪৪টি পদ। সে অনুযায়ী সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট পদের বিপরীতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানগুলোয় অধ্যাপকদের জন্য পদ রয়েছে ৮০১টি। এর মধ্যে ৫২৫টি খালি, যা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট অধ্যাপক পদের ৬৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সহযোগী অধ্যাপকের পদ খালি ৬০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ১ হাজার ৩৭১টি সহযোগী অধ্যাপক পদের ৮৩৬টিই খালি রয়েছে। এছাড়া সহকারী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ১০০ পদের বিপরীতে ৮৩৩টি (৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ) এবং ১ হাজার ৩৯৬ প্রভাষক পদের বিপরীতে ৩৫০টি (২৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ) খালি রয়েছে।

সরকারি মেডিকেল কলেজের সংকটগুলো ক্রমান্বয়ে সমাধান করা হচ্ছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিঞা। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মেডিকেল শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা অ্যাক্রিডিটেশন আইনও পাস করেছি। এটা সত্য সব মেডিকেল কলেজ একই মানের নয়। তবে আমরা সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হচ্ছি। যেসব মেডিকেল কলেজের সক্ষমতা বেশি, জায়গা বেশি সেসব মেডিকেল কলেজে আসন বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষকের কিছু সংকট রয়েছে। তবে শিগগিরই বড় একটি সংখ্যার সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি হবে। বেসিক সায়েন্সের শিক্ষক সংকট বেশি। কেননা এসব বিষয়ে সারা দেশেই লোকবল কম। তবে এসব বিভাগ থেকে অবসর নেয়া অধ্যাপকদের চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোসহ সব হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। তাই কলেজের আসনও বাড়ানো হয়েছে। এ আসনে ভর্তি হবে আগামী বছর থেকে। আসন হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়নি। অনেক পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করেই বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের বিদ্যমান সংকট আগামী এক বছরের মধ্যে অনেক কেটে যাবে। এর পরও যেসব সমস্যা থাকবে তা ধারাবাহিকভাবে সমাধান করা হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার রাঙ্গামাটি, পাবনা, নোয়াখালী, কক্সবাজার, যশোর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, পটুয়াখালী ও নেত্রকোনা প্রতিনিধি)

Source: Bonik Barta

Share the Post: