সরকারি স্বাস্থ্যসেবা: জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক সবচেয়ে কম কুড়িগ্রামে

ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষা উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম। অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এ জেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবারও বেহাল দশা। জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে কম সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন এ জেলায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় না বললেই চলে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালই এ জেলার বাসিন্দাদের ভরসা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রামে প্রতি ৪০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন একজনেরও কম (শূন্য দশমিক ৯২)। আর দেশের অন্য ৫০টি জেলায় গড়ে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে রয়েছেন একজনের কম সরকারি চিকিৎসক। চিকিৎসক সংকটের দিক থেকে কুড়িগ্রামের পরই যথাক্রমে গাইবান্ধা, ভোলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও জেলার অবস্থান।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। সেই সঙ্গে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এ সংকট প্রবল হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানে (৬১৮টি হাসপাতাল) ২৬ হাজার ৮৯১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। সে হিসেবে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন ১ দশমিক ৫৫ জন। আর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অনুপাত সাতজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কুড়িগ্রাম জেলায় চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৫৪ জন। অর্থাৎ প্রতি ৪৩ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন। এ জেলায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে সেকেন্ডারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি চিকিৎসকের সংকট আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও পুরোপুরি কাটেনি। এর মধ্যেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে একটি রোগীও ফিরে যায়নি। তার দাবি, চিকিৎসকের সংকট থাকলেও চিকিৎসা সেবায় কোনো ঘাটতি নেই।

সরকারি চিকিৎসক সংকটের দিক থেকে কুড়িগ্রামের পরই যেসব জেলার অবস্থান সেগুলোর মধ্যে গাইবান্ধায় প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন শূন্য দশমিক ২৪ জন; ভোলায় শূন্য দশমিক ২৫ জন; চাঁপাইনবাবগঞ্জে শূন্য দশমিক ২৮ জন; লালমনিরহাটে শূন্য দশমিক ২৮ জন এবং ঠাকুরগাঁওয়ে শূন্য দশমিক ২৯ জন।

উপজেলায় কনসালট্যান্ট পদে লোকবলের সংকট থাকলেও মেডিকেল অফিসারের তেমন একটা সংকট নেই বলে জানান গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. আ ম আখতারুজ্জামান। তিনি জানান, গাইবান্ধায় ২০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসকের কিছুটা সংকট রয়েছে। আর আটটি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে শুধু সাদুল্ল্যাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন মাত্র কনসালট্যান্ট রয়েছেন।

সম্প্রতি ৩৯তম বিসিএস থেকে নিয়োগের পর চিকিৎসক সংকট কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার।

চিকিৎসকের সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসক সংকট রোধে শুধু বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের ওপর নির্ভরতা ছাড়তে হবে। মোট শূন্য পদের বিপরীতে হিসাব করলে সংকট বোঝা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসকের পদই কম। তাছাড়া চিকিৎসকরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের থাকতে চান না।

এ সমস্যার কথা জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাও। তারা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের বদলি ও পদায়ন করা হলে তারা সেখানে থাকতে চান না। উপজেলা পর্যায়ে বদলি বা পদায়ন করা হলে বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে তা ঠেকাতে তদবিরও করা হয়। যথাযথ সুযোগ-সুবিধা এবং জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে দূরে হওয়ায় উপজেলা কমপ্লেক্সে কাজ করতে আগ্রহী হন না চিকিৎসকরা।

গ্লোবাল হেলথ রিপোর্ট ২০২০-এ (ভলিউম-৪) বাংলাদেশের মফস্বল পর্যায়ে কাজ করতে চিকিৎসকদের অনাগ্রহ নিয়ে একটি গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে।

চিকিৎসক সংকট নিরসনে আইন ও নিয়ম পুনর্গঠনের কথা বলছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়োগের আইন সংশোধন করতে হবে। বিসিএসের মাধ্যমেই নিয়োগ দিতে হবে এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দিতে হবে।

তিনি বলেন, দেশে চিকিৎসকের তেমন একটা সংকট না থাকলেও সরকারি চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। মোট জনসংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসকের সংখ্যা রাখা হয়েছে কম। ঢাকায় বসে কেন্দ্রীভূতভাবে নিয়োগ দিলে চলবে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। ৩৯তম বিসিএসের পর তা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। ঘাটতি ও সংকটের মধ্যে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সংকটের জন্য কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে না। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবারও ভূমিকা রয়েছে।

এদিকে সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যাও যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে শেরপুর। এ জেলার প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে শয্যা সংখ্যা ১ দশমিক ৩০টি। প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে দুটি শয্যাও নেই এমন জেলা রয়েছে আরো ১৯টি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: