দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের খাবারের ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষই করে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে। অর্থাৎ রোগীপ্রতি মাথাপিছু একটি নির্দিষ্ট অংকের বরাদ্দ দেয়া হয়, যে অনুযায়ী রোগীদের তিনবেলা আহার সরবরাহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত এক দশকে দেশে প্রায় ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি রোগীপ্রতি সরকারি বরাদ্দ। ২০১৩ সালে একজন রোগীর খাবারের জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হতো, ২০২২ সালে এসেও তা বাড়েনি। বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই কমেছে খাবারের মান। অথচ একজন অসুস্থ মানুষের সুস্থতার জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ সুষম ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। যার সঠিক জোগান দিতে পারছে না সরকারি হাসপাতালগুলো। ফলে রোগীর পুষ্টির চাহিদা মিটছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সাধারণ স্কেলের ডায়েটের দৈনিক বরাদ্দ ১২৫ টাকা। এর মধ্যে সকালের নাশতার জন্য বরাদ্দ ৩৩ টাকা, দুপুর ও রাতের খাবারে ৯২ টাকা। তবে পুরো ১২৫ টাকাই রোগীর জন্য ব্যয় হয় না। সেখান থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ১০৬ টাকায় দেয়া হয় রোগীর তিনবেলার খাবার।
অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি রোগীর খাবারের একটি সর্বজনীন মেন্যুও ঠিক করে দেয়া হয়। ২০১৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত সকালের নাশতার জন্য গড়ে ১৫০ গ্রাম পাউরুটি, চার ইঞ্চির একটি কলা, ২০ গ্রাম চিনি ও একটি ডিম দেয়ার কথা বলা হয়েছে। দুপুর ও রাতের খাবারে প্রতি বেলায় এক কেজির রুই বা কাতল মাছের ১৪০ গ্রামের টুকরো অথবা ৩৪০ গ্রাম মুরগির মাংস, একই ওজনের ভাত, ৪০ গ্রাম মসুর ডাল, সবজি (পেঁপে ও আলু) ৪০০ গ্রাম, সয়াবিন তেল (উন্নত মানের) ২৫ গ্রাম, পেঁয়াজ ৫০ গ্রাম দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এর আগে ২০০৯ সালে রোগীপ্রতি বরাদ্দ ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়। ২০১৩ সালে এসে তা বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করা হয়। হাসপাতালগুলো রোগীর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাবার সরবরাহ করে। প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে। শয্যার বাইরেও যেসব রোগী থাকে তাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ১০ শয্যা, ২০, ৩১, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিভিন্ন শয্যার হাসপাতালের সংখ্যা ৪৮৫। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যার ৬২টি জেলা, ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল ও এক হাজার থেকে আড়াই হাজার শয্যার টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ের ৩০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৪৯ হাজারের কিছু বেশি। মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের প্রায় সব হাসপাতালে শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী সাধারণত ভর্তি থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স হাসপাতালে চিকিৎসক ও নিবন্ধিত পুষ্টিবিদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কারণ হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে হাসপাতালে থাকাকালীন খাবার গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে রোগীকে বাইরের খাবার দেয়া হয় না। রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ খাবারও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেয়। একই সঙ্গে রোগীর পছন্দকেও গুরুত্ব দেয়া হয়। রোগীরা তার পছন্দ অনুযায়ী খাবার বেছে নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই তার স্বাস্থ্যগত বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, পুষ্টিকর খাবার দিতে গেলে বরাদ্দের এ টাকায় সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ১ হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ক্যালোরির খাবার প্রয়োজন। তবে রোগী ভেদে এর ভিন্নতা থাকতে পারে। রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী তার ডায়েটও আলাদা হবে। তবে বর্তমানে ১০৬ টাকায় প্রয়োজনীয় চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা কঠিন। খাবারের বরাদ্দ অবশ্যই বাড়াতে হবে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত পাঁচটি মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল ঘুরে দেখা গিয়েছে, রোগীদের জন্য রান্না করা খাবারে সরকারের নির্দেশনায় উল্লেখিত পরিমাণ নেই। মুরগির মাংসের পরিমাণ ৩৪০ গ্রাম দেয়ার কথা থাকলেও তা ৫০-৬০ গ্রামের মতো। পাউরুটি ১৫০ গ্রামের জায়গায় ১০০ গ্রাম, মাছ ১৪০ গ্রামের বদলে ৫০ গ্রাম করে দেয়া হচ্ছে। বরাদ্দ অনুযায়ী পরিমাণ নিশ্চিত করা কঠিন হওয়ায় মানও ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
সরকারের বরাদ্দ অনুযায়ী ঠিকাদার খাবার সরবরাহ করে উল্লেখ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বরাদ্দের সর্বোচ্চ খাবার নিতে আমরা চেষ্টা করি। তবে এ বরাদ্দে ঠিকাদারকে আর বেশি চাপ দেয়া সম্ভব নয়। তারাও তাদের সাধ্যমতো সরবরাহ করার চেষ্টা করছে। স্থানীয় স্কেল অনুযায়ী আমরা ডায়েটের তালিকা করি। সে অনুযায়ী ঠিকাদার খাবার দেয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলছেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়েও হাসপাতালে সাত রকমের ডায়েট দেয়া হতো। রোগীদের জন্য বিভিন্ন স্কেলে ডায়েট প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য সঠিক ডায়েটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ডায়েট নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে, বরাবরই রোগীরা অভিযোগ করে যে হাসপাতাল থেকে সরবরাহকৃত খাবার সুস্বাদু হয় না। হাসপাতাল থেকে যে পরিমাণ বা মানের খাবার দেয়া হয় তার ওপর নির্ভর করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের জন্য বাড়ি থেকে অথবা কিনে খাবার আনেন স্বজনরা। অসুস্থতার সময় পুষ্টি ঠিক রেখে খাবারের বৈচিত্র্য ও স্বাদ না থাকায় হাসপাতালের খাবারে তাদের আগ্রহ থাকছে না। আর সকালে, দুপুরে ও রাতে খাবার দেয়া হলেও বিকালে বা অন্য সময়ে কোনো নাশতার ব্যবস্থা নেই। সে সময়ও রোগীদের বাইরে থেকে কিনে বা বাড়ি থেকে এনে নাশতা খেতে হয়।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট বলছে, সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার ছাড়াও রোগীকে স্ন্যাকস সরবরাহ করা জরুরি। দেশটিতে স্ন্যাকস হিসেবে ফলের রস, দই, তাজা ফল, চা, কফি, চকোলেট, বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখা হয়।
কোনো ধরনের ক্যালরির হিসাব না করেই রোগীদের খাবার দেয়ার অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রোগীদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে খাবারের জন্য দৈনিক বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানেও তাদের জন্য ডাল, মাংস, মাছ, ডিম, কলা থেকে শুরু করে খাবারে ভিন্নতার চেষ্টা করা হয়। তবে চলমান বরাদ্দে তা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়কে দৈনিক ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছি। আশা করি এর কাছাকাছিও বরাদ্দ রাখা হলে রোগীদের জন্য আরো ভালো খাবার তৈরি করে সরবরাহ করা যাবে।